ওয়াশিংটন স্টেটকে বলা হয় “চির সবুজের রাজ্য” (Evergreen State) । আমরা যখন ওয়াশিংটন স্টেটের বৃহত্তম বন্দরনগরী সিয়াটলে নামলাম, বাংলাদেশে তখন গভীর রাত।   বিদেশ আসার আগে কালচারাল শকের কথা অনেক শুনে আমি মোটামুটি প্রস্তুতই ছিলাম। কিন্তু এত স্পর্শকাতর বিষয়ে এমন করে শক খাব ভাবতেই পারিনি। এয়ারপোর্ট এ সারি সারি সাজানো ছবির মত বাথরুমে কোন পানির ব্যবস্থা নাই (ফ্ল্যাশ ছাড়া)! জামাইরে ফোন দিলাম কনফার্ম হইতে! গজগজ করে বললাম উচ্চশিক্ষিত হতে কোন খবিসের দেশে আসলাম! অবশ্য জামাই যখনি সুন্দরী ললনাদের দিকে তাকাচ্ছিলো তাকে ফিসফিস করে তাদের শৌচাগার এর কথা মনে করিয়ে দিতে লাগলাম।

এখানে এসেই প্রথমেই আমরা অনুধাবন করলাম, বিদেশ থাকলে, কেন সবার বাংলার ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়। খাবার মেনু দেখে অন্যরা যেন না বুঝে সেজন্য ইংরেজীর বঙ্গানুবাদ করে আমি বল্লাম, মুঠোফোন এ গনকযন্ত্র বের করে, আগে ৮০ দিয়ে গুন করে দেখো কত টাকা আসে। আমাদের বাংলা ভাষায় কতযে ইংরেজি শব্দ আগে কখন খেয়ালই করি নাই। পরিচিত এক বাংগালি ভাবি একদিন বাসায় এসে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বল্লেন, “আমি তোমার মুঠোফোনের তারযন্ত্র লুকিয়ে রেখেছি, তরিতকোষে শক্তি থাকলে আমার ছেলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত খেলতেই থাকবে”।উনার অল্প বাংলা জানা অতি বুদ্ধিমান ছেলে বুঝতেই পারলো না সবজান্তার যে কত অজানা থাকে।

যাইহোক আটঘন্টার ট্রানজিট, অথচ গন্তব্য স্পোকেন মাত্র একঘন্টার প্লেন জার্নি। দীর্ঘ পথের ক্লান্তির কাছে হার মেনেছে, স্বপ্নের কাছাকাছি আসার আনন্দ আর কৌতূহল। চেকিং পার হয়ে হাতে আরো সাতঘণ্টা, সাথের সহযাত্রী আমেরিকান এক লেখিকা (কোলকাতার বংশদ্ভুত, ঊনাকে নিয়ে একদিন একটা গল্প লেখার ইচ্ছা আছে), উনি আমন্ত্রন জানালেন, বোরেন পার্কে(Louisa Boren Park) সুর্যাদয় দেখার, উনার ফ্লাইট পাচ ঘন্টা বাদেই, উনার এক ফ্রেন্ড আসবে উনাকে নিয়ে আবার পাচ ঘন্টার মধ্যে দিয়ে যাবে। আমি কৌতুহলে ফেটে পড়লেও, বারবার বরের দিকে তাকাচ্ছি সম্মতির আশায়। আমরা প্লেন থেকে নামার সময় উনার ফোন নাম্বার ইমেইল আইডি নিয়ে নিলাম। উনি এইখানে প্রায়ই আসেন তাই মোটামুটি, আমাদের সবরকমের ডিরেকশান দিয়ে দিলেন। আরো বললেন উনার ফ্রেন্ড আসবে, আমরা চাইলে একসাথে কোথাও ব্রেকফাস্ট করতে পারি, এরপর উনারা লুইসা বোরেনে যাবেন। সিয়াটল ছিলো আমাদের ফার্স্ট পোর্ট অব এন্ট্রি, সুতরাং উনাদের সাথে ব্রেকফাস্ট কোনভাবে কাটানো গেলেও, চেকিং এর পুরো সময় আমি বরকে অনুনয় বিনয় করতে লাগলাম, সাত ঘন্টায় কিভাবে আমরা বোর হয়ে যেতে পারি, তাই অনেক গল্পের মাধ্যমে তাকে বোঝাতে লাগলাম। সেওকি কম যায়? কিভাবে বাংলাদেশি জ্যাম সুদুর আমেরিকাতে আমাদের ফ্লাইট মিস করাতে পারে, কিভাবে আমাদের উনারা ছেলেধরাদের মত ধরে নিয়ে যেতে পারে ইত্যাদি বলে সে যখন একদম কঠিন ‘না’তে চলে এসেছে আমি তখন আমার সর্বশেষ অব্যর্থ অস্ত্র প্রয়োগ করলাম। আমার চোখের পানির গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে, ব্যাগ বুঝিয়ে দিলো পরবর্তি গন্ত্যবের উদ্ধেশ্যে। প্রত্যেকটা ব্যাগের গায়ে গর্বিত মায়ের হাতে বড় করে তার ছেলের নাম আর ইউনিভার্সিটির নাম লেখা। ৭০০০ মাইলে দুরের প্রিয় একটুকরো স্বদেশের আমার চোখের পানির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো।

আমরা যখন সবকাজ শেষে মেইন গেইটে পোওছুলাম , দূর থেকেই দেখলাম মিমি মুখারজি আর উনার সোনালী চুলের বিশালদেহী আমেরিকান বন্ধু হাসিহাসি মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই বললেন, উনাদের নাস্তা করা শেষ, ভেবেছেন আমরা হয়ত যাবো না তাই রওয়ানা দিচ্ছিলেন। আমরা যদি যেতে চাই, কুইক ব্রেকফাস্ট কিনে গাড়িতে খেতে খেতে যেতে হবে, যদিও সুর্যদয় ধরতে পারবোনা। আমরা এক  ছুটে ম্যাকডোনাল্ড থেকে কিছু কিনে নিয়েই দে ছুট। হাল্কা আলোয় গাড়ি ছুটে চলছিল অচেনা পাহাড়ি রাস্তা ধরে। রেডিওতে হাল্কা তালের একটা গান বাজছে। এই সেই” স্লিপ লেস ইন সিয়াটল!” একপলকেই মন ছুটে গেলো খুলনার  শহরের সেই বাসাতে, খালিশপুরের সেই বাসা থেকে খা খা দুপুর সারি সারি মেহগনির ছায়ায় হাটতে হাটতে টুইশনিতে যেতে যেতে স্বপ্নেও কি কখনও ভেবেছি, আগের রাতে দেখা সেই অসাধারণ প্রেমের সিনেমার নায়িকাটার মত আমিও একদিন সিয়াটলের বুকে ঘুমহীন চোখে ছুটে যাব?  ফ্রেঞ্ছ ফ্রাই চিবুতে চিবুতে, ক্লান্ত মাথা এলিয়ে দিয়ে খেয়াল করলাম, বেচারার মুখ ভয়ে পাশুটে হয়ে গেছে। বরাবরই সে ভিতু প্রকৃতির লোক।  সারাজীবন যে লোকটাকে কমপ্লেইন করেছি, তুমি এত ভীতু কেন? বয়ফ্রেন্ড আর স্বামীগুলা হবে সিনেমার নায়কের মত, গুন্ডা দেখা মাত্র জাপায়ে পড়বে, তানা তুমি আমাকে নিয়ে রাত্রে বের হতে চাও না, জটলা দেখলে নিচে যাওয়া বন্ধ, এইগুলা হইলো কিছু? আর একদিন সেই লোকটাই অসীম সাহসের একটা কাজ করে ফেললো। প্রথমবার জি.আর.ই তে প্রচন্ড ডাব্বা মেরে, সে আমাকে বললো, “আমি আমার চাকুরিটা ছেড়ে দিবো, তুমি যদি আমাকে এক বছর সাপোর্ট দাও”।পাগলা কিসিমের লোক মাঝে মাঝেই উড়াধুড়া ডিসিশান নেয়, পড়ে অবশ্যি ঠিক হয়ে যায়, আমি বললাম আচছা দুইদিন ছুটি আছে চিন্তা করে বলো। আমি মোটামুটি শিওর ছিলাম যে এইটা কোন পারমানেন্ট ডিসিশান না। দুইদিন পরও যখন সে বললো একবার দেখতে চায় পারে কিনা, তারমানে আমি জানি এইটা একটা সিরিয়াস সিদ্ধান্ত। আমার প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড-পাচবছরের দুর্দান্ত প্রেমের পর বর্তমান বর, সুতরাং আমি জানি সে যদি বলে সে এইটা করবে দুনিয়ার কেউ আর তাকে দাবায়া রাখতে পারবেনা। প্রত্যেক ফার্মেসি পড়ুয়ার জন্য স্কয়ারের ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিং স্বপ্নের জায়গা, মার্চ মাসে আমরা যখন ঠিক করলাম যে, আমরা এই যুদ্ধে নামব। আমাদের পরিচিত মহলে তা ছিলো ব্যপক একটা ধাক্কা। বৃহস্পতি বার এ যে ছেলেটার পনের দিনের জন্য কেনিয়া ট্রিপের প্রপোজাল জমা দিয়েছে, এইবছরেই যে ছেলেটাকে পারফেক্ট টাইমে বস প্রমোশান দিয়ে দিয়েছে, রেজিগনেশান দেয়ার সময় বস যখন ওকে বলেছিল তুমি ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে আমাকে এক সপ্তাহ পরে বল, সে নিরুতাপ ভাবে বলেছিলো  Sir, I think you know, I came from a mediocre family, I am the eldest and only one son of my family . In this stage when I am 27 years old, such life changing decision cannot be just a whim, but calculative risk that I taken to chase my goal.

নির্ঝর চাকুরি ছাড়লো এপ্রিল,২০১৪ আর ইউ এস এ আমরা আসলাম আগস্ট ২০১৫ এই ১৬ মাস এর প্রতিটা দিন এক একটা ইতিহাস। একটা স্বপ্ন পুরনের ইতিহাস, সমাজের ভ্রুকুটির দাত ভাঙ্গা জবার তৈরির ইতিহাস। স্বপ্নগুলো আসলে চারাগাছের মত, বীজবুনে মাসের পর মাস গাছের দেখা না পেলেও নিয়মিত আলো, ছায়া, পানি দিয়ে যত্ন করতে হয় মানুষ শুধু ফলের ভারে নুয়ে পড়া গাছ দেখে। এই গাছকে মহিরুহে পরিনত করতে চাষির রোদে পোড়া, বৃস্টিতে ভেজা শ্রম কেউ দেখে না।

জব ছাড়ার পর শুরু হল ফোন কলের বন্যা, তবে খুব ভালো লাগতো অনেক মানুষই অনুপ্রেরনা পেত ওকে দেখে, সবাই জানতে চায় সত্যি কারনটা, কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। আমরা ততদিনে কোমর বেধে প্রস্তুত “সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কিসের ভয়!” স্কয়ার থেকেই অসংখ্য মানুষ ফোন দিতো, কি পড়তেছে, সবার ধারনা ছিলো হয়ত কোথাও থেকে এডমিশান কনফার্ম হয়েছে, কারোই যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা শুধু প্রিপারেশান নেয়ার জন্য কেউ এত বড় রিস্ক নিছে। আরও মজার ব্যাপার ছিলো ব্যপনের একটা সেমিনার এ (ওটাই বোধহয় ব্যপনের ফাস্ট সেমিনার ছিলো) যেয়ে ওর বেশ কিছু এক্স কলিগের সাথে দেখা যারা অফিসের কাউকে জানাতে চায় না যে তারা বাইরে যাওয়ার ট্রাই করছে। যে খানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয় সে কথা সত্যি প্রমান করে তার কিছু দিন পরেই ব্যপনের হোমপেইজে তাদের বড় করে ছবি চলে আসলো , তারচেয়েও মজার ব্যাপার হচ্ছে যে তিনজনের ছবি ছিলো তিনজনই এখন ইউ এস এ তে।

ভাবনার ফাকেই চলে এলাম বোরেন পার্ক এ, পার্কের পাশে বিশাল ছায়া ঢাকা সিমেট্রি, নাম না জানা অসংখ্য ফুলের সমাহার, কতশত এপিটাফে হারিয়ে যাওয়া সব মানুষের নাম, পথে যেতে পাশাপাশি দুটো এপিটাফ অদ্ভুত সুন্দর! একটা রক্তলাল গ্রানাইট পাথর আর একটা কালো গ্রানাইট এর, পেছন থেকে মিমি বলে উঠলেন এটা ব্রুস লি আর তার ছেলে ব্রেনডন লীর গ্রেইভ। দেশ ছেড়ে আসার পড় বার বার সবাইকে এত মিস করছিলাম, এত তাড়াহুড়া আর কোতুহলে যাও ভুলে ছিলাম ব্রেনডন লীর এপিটাফের সেই লেখা দেখে আমার অঝরে কান্না, এত অসাধারন লাইন! হয়ত একটা জীবন চলে যায় আমাদের, অতটকু লাইন উপলব্ধি করতে

“Because we don’t know when we will die, we get to think of life an inexhaustible well.

Yet everything happens a certain number of times, and a very small number.

How many more times will you remember a certain afternoon of your childhood, some afternoon that’s so deeply a part of your being that, you can’t even conceive of your life without it? Perhaps four or five times more. Perhaps not even that. How many times will you watch the full moon rise? “Perhaps Twenty.” And yet it all seems limitless!”

ভেজা চোখ নিয়ে বোরেন পার্কের বেঞ্ছিতে দুইজনে বসে আছি,লেক ওয়াশিংটনের ঝিরিঝিরি বাতাস , দুরের শুভ্রতুষার ঢাকা পাহাড়ের ফাক দিয়ে উকি দিচ্ছে সকালের সোনালি সুর্য, যেন জানান দিচ্ছিলো নতুন আগামীর বারতা, যারা স্বপ্ন দেখতে জানে তারাই কেবল জানে স্বপ্ন পুরনের আনন্দ, আর জানে স্বপ্ন ভাঙ্গার বেদনা, পরমকরুনাময় এই জগতের প্রতিটি প্রানীর স্বপ্ন পুরন করুন, নতুন আলোয় আলোকিত হোক সবার জীবন…।


চির সবুজের রাজ্যে সিরিজের গল্পসমূহঃ

 পর্ব ১ঃ প্রারম্ভিকা