স্পোকেন যাওয়ার ছোট বিমানটা দেখে যতটা না আশাহত ছিলাম, তারচেয়ে বেশী আতঙ্কিত হয়েছিলাম। রাইট ব্রাদারসের বিমানটাইতো মনে হচ্ছে! ঐতিহাসিক সেই ছোট বিমানের ভেতরটা অনেকটা আমাদের লোকাল বাসের মত। সিয়াটল থেকে স্পোকেন যাত্রাটা ছিল পুরোই রোলার কোস্টারের হরর ভার্সন। জানালার বাইরের কাচের ওপাশের সারি সারি পাহাড়, সাদা গ্লেসিয়ারের চূড়ায় সুর্যের ঝলকানি, পাহাড়ের অনেক উপরে নীল পানিতে রোদের ঝিকিমিকি, কোনকিছুই আর আমাকে আকর্ষন করছেনা। একমনে দোয়া ইউনুস পড়েই যাচ্ছি। বরের দিকে শুকনামুখে তাকাতেই সে আমাকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করলো, আরে এইটুকু বাম্পিং এ ভয় পেলে হবে? তুমি হচ্ছো বাঙ্গালী ললনা, মিরপুর ১০ থেকে কাজীপাড়া যেতেই তো এর থেকে বেশী ঝাকানি খাইতা। আমি চিকন গলায় বললাম, বিমানবালার কাছে কি পলিথিন চাইব নাকি? আহা, আমাদের লংরুটের কন্টাক্টাররা কতই না কেয়ারিং ছিলো! বাসে উঠার পরপরই এসে জিজ্ঞাসা করতো, আফা পলিথিন লাগবো। আর এরা ? হুহ!

প্রায় ঘন্টাখানিক প্রচন্ড ঝাকুনির পর বিমান যখন পুরা দুইবার স্পোকেন শহর চক্কর দিয়ে ল্যান্ড করলো, আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এরপর বাংলাদেশে গেলে দরকার হলে হেঁটে হেঁটে সিয়াটল যাবো, তবু ডোমেস্টিক বিমানে যাবোনা। আমি বিমান থেকে নেমে হাফ ছেড়ে বাচলাম। গ্রীষ্মের তাতানো রোদে রানওয়ের পিচ চকচক করছে, বাতাসে পাইনের মিস্টি সুবাতাস। মজার ব্যাপার হচ্ছে  স্পোকেন শহরে আমরাই প্রথম বাংলাদেশি। ইন্টারনেট ঘেটে ওয়াশিংটন স্টেটের কয়েকজন বাংলাদেশির কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, এইখানে কোন বাংলাদেশি আছে বলে তাদের জানা নেই। ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি স্কুলটা মুল ক্যাম্পাস পুলম্যান (যেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টগুলো) থেকে অনেক দূরে। ফার্মেসী স্কুলে আগে তেমন ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট নেয়া হয়নি (আগে মাত্র তিনজন ছিল)। ২০১৫ তেই মনে হয় একসাথে এতগুলো (চারজন) ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট নেয়া শুরু হয়। আর সেজন্য ভাগ্যচক্রে অথবা ভাগ্যক্রমেই বলা যায়, বাংলাদেশি শুন্য এই শহরে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের পথচলা শুরু হলো।

ব্যাগের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, এর মধ্যেই সাদিক ভাই চলে এলেন। উনাকে ছবি দেখে যতটা বয়স্ক মনে হচ্ছিলো, বাস্তবে তার উল্টোটাই মনে হলো। এসেই এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন মনে হচ্ছিলো যেন আমরা বহুদিনের পরিচিত। এইখানে কোন বাংলাদেশী না থাকায় নির্ঝরের প্রফেসর উনার ল্যাবের দুইজন ভারতীয় পোস্টডকের মেইল আই ডি দিয়েছিলেন। তাদেরই একজন সাদিক ভাই আর অন্যজনের নাম আনিল, উনিও এসেছিলেন আমাদের রিসিভ করতে। আসলে দেশ, জাতীয়তাবাদ যে, মানুষের সুসম্পর্কের কোন অন্তরায় হয়না, এইখানে এসে বহুবার বুঝেছি। আমাদের বাসা খোঁজা থেকে শুরু করে, নতুন সংসারের জিনিসপত্র কিনা, বাজার সব সাদিক ভাই একাই করেছেন। আমরা আসার আগেই নতুন বাসার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, এমনকি দুইমাসের এডভান্স, সিকিউরিটি ডিপোজিট সহ বেশ বড় আমাউন্টের টাকা নিজের পকেট থেকেই দিয়েছিলেন। যাইহোক সব লাগেজ গাড়ীতে তুলে আঁকাবাঁকা পথধরে গাড়ী ছুটলো। নির্ঝর গল্প করছিলো ল্যাব, ক্রিকেট এইসব নিয়ে আর আমি এই ফাঁকে দেখে নিচ্ছিলাম, শহরটাকে। ঝকঝকে পাহাড়ী রাস্তায় ছুটে চলছে অসংখ্য গাড়ি, কোন প্যা প্যা ভো ভো শব্দ নেই, এমনকি রাস্তার পাশে কোন মানুষও নেই, ছোট ছোট টং দোকান ও নেই। পরে জানতে পেরেছিলাম, এই রোডটা একটা বিখ্যাত হাইওয়ে, যেটাকে বলে আই-৯০ (ইন্টারস্টেইট হাইওয়ে)। এটাই ইউ.এসের সবচেয়ে দীর্ঘ ইন্টারস্টেইট হাইওয়ে।

আপ্যার্টমেণ্ট কমপ্লেক্স এর ভিতরেই খুব সুন্দর করে সাজানো একটা অফিস। আমি ভেবেছিলাম কোন একটা বাড়িতে নক করলে বাড়িওয়ালা বের হয়ে চাবি হাতে দিয়ে দিবে ব্যাপারটা মোটেই সেইরকম না। ম্যানেজার এর রুমে যেতেই উনি একটা বিশাল ফাইল বের করলেন। এইখানে বাড়িভাড়া হয় লীজ হিসেবে, আমরা ছয়মাসের কনট্রাক্ট করলাম। তারপরে পুরাই নৈবৃত্তিক প্রশ্নের মত আমরা প্রায় এক ঘন্টা ধরে হ্যাঁ/ না দাগাতে লাগলাম। কত যে বিচিত্র সেইসব প্রশ্ন তা দিয়ে বিশাল এক উপন্যাস হয়ে যাবে। দীর্ঘ সই স্বাক্ষরের পর ঊনি আমাদের কনগ্রাচুলেশান জানিয়ে চাবির গোছাখানি হাতে দিলেন, আমিও ভাবলাম কাজ বুঝি শেষ। সে আশায় গুঁড়েবালি, বিশাল ভপু-ম্যানেজার হেলতে দুলতে ফাইল হাতে আমাদের সাথে রওয়ানা দিলেন। প্রায় ৫০ টার মত ভিক্টোরিয়ান সাইজের একই রকম সব কাঠের বাড়ী নিয়ে বেশ বড় একটা কমপ্লেক্স। খড়খড়ে রোদে হেঁটে প্রতিটা চাবি দিয়ে একে একে সুইমিংপুল, বাস্কেটবল কোর্ট, জিম, গ্যারেজ খোলার পর উনি ছোটখাট বক্তৃতা দিচ্ছিলেন সে গুলার নিয়মকানুন নিয়ে, বুঝতে পেরেছি বলে মাথা নাড়তেই আমাদের সই নিয়ে নিচ্ছিলেন। আমি না পেরে নির্ঝরকে বলেই ফেললাম, বাড়িটা কি আমরা কিনেই ফেলছি না ভাড়া নিয়েছি দেখছ ভালো করে? হাঁটতে হাঁটতে যখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি অবস্থা, ঊনি একটা বাসার সামনে এসে দরজা খুলে বললেন, ওয়েলকাম টু ইয়োর হোম, প্লিজ সাইন হিয়ার। পরে তার নাম আমি দিয়ে ছিলাম সিগনেচার পিটার। একদিন সে কথা শুনে তার সেকি হো হো হাসি।

ব্যাগ-বোচকা সব বাসায় রেখে সাদিক ভাইয়ের বাসায় যাত্রা করলাম, উনি ব্যাচেলর মানুষ, অথচ রান্নার বিশাল আয়োজন দেখে আমরা মুগ্ধ। সেইরাতে আমাদের আর কিছুতেই বাসায় যেতে দেননি। প্রথমে না না করলেও পরে মনে হয়েছিলো নেট কানেকশান না নিয়ে সেইদিন বাসায় গেলে, আসলেও মন খারাপ হতো। উনার বাসা থেকে আমাদের দুইজনের বাসায় স্কাইপেতে বার বার কথা হচ্ছিল, তাই মন খারাপ হচ্ছিলোনা মোটেও।

ওরিয়েন্টেশানের কয়েকদিন আগেই আমরা চলে এসেছিলাম, জেটল্যাগ কাটতেই দুইদিন চলে গেলো। এর মধ্যে সকাল-বিকেল আশেপাশে এলাকায় দুজন হেঁটে দেখে নিয়েছি। খুব ভোরে হাঁটতে বের হই, মনে হয় যেন রূপকথার সেই ঘুমন্ত শহর, পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে সব একতলা কাঠের বাড়ি। চারিদিকে সবুজ ঘাস (আমি ভাবতাম প্লাস্টিকের ঘাস, পরে আমি একমুঠো ঘাস বাসায় এনে পরীক্ষা করে দেখেছি), নাম না জানা সব ফুল আর গাছ গাছালিতে ঘেরা। সকালের মৃদু বাতাসে গাছে লাগানো দোলনাগুলো দুলছে অথচ কোন মানুষের দেখা নেই। দেশে যেমন রাস্তায় হেটে যেতে একজনকে রাস্তা জিজ্ঞেস করলে, মোটামুটি ভলান্টিয়ার এর ভিড় পড়ে যায় রাস্তা চিনাতে, এই খানে গুগল ম্যাপই একমাত্র ভরসা। এ যেন সবাক চলচিত্র থেকে হঠাত কোন নির্বাক চলচিত্রের রাজ্যে চলে এসেছি। মাঝে মাঝেই টুনা-টনি একটু একটু করে এটা সেটা কিনে আনি, পুরোই নতুন করে আবার সংসার শুরু। ঢাকার অলিতে গলিতে বাজার জমে দেখে এত বিরক্ত হতাম, জ্যাম এর জন্য রিকশার উপরও খুব বিরক্ত হতাম। এখানে এসেই সেগুলোকে মিস করা শুরু করলাম। যদিও বাসার খুব কাছেই ওয়ালমার্ট আর উইনকো নামের বেশ বড় আরেকটা গ্রোসারি আউটলেট তবু বেশ খানিকটা পাহাড়ি ঢালু পথ হাঁটতে হয়। আর পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাটা, তখন থেকে এখন পর্যন্ত আমার কাছে একটা বিস্ময়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস, রাস্তায় কিছুদূর পরপর বাসস্ট্যান্ড গুলোতে ১৫ মিনিট পরপর বাস আসছে। আমি কখনোই বাসে ৯ থেকে ১০ জনের বেশী লোক দেখিনি। গুগল ম্যাপে নিজের লোকেশান দিয়ে গন্তব্যের লোকেশান দিলে, পরবর্তী বাস কখন আসবে তাও জানিয়ে দেয়; প্রত্যেক রুটের জন্য বাসের নির্দিষ্ট নাম্বার আছে, কত নাম্বার বাসে উঠতে হবে তাও দেখা যায়। কন্ডাক্টর এর বালাই নেই, দেড় ডলার বক্সে ফেললে, টিকিট বের হয়ে আসে। সেটা দিয়ে ২ ঘন্টায় যেকোন বাসে চড়া যায়। আর নির্ঝরের তো ইউনিভার্সিটির কার্ড পাঞ্চ করলেই হয়, যেকোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ফ্রি। এইখানে বাসগুলোতে বুড়োদের যেমন রিজার্ভ সিট থাকে, তেমনি প্রতিবন্ধীদের ও থাকে। হুইলচেয়ার সহ কেউ স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করলে, বাস এর দরজা থেকে হুইলচেয়ার উঠার জন্য একটা মেকানিকাল পাটাতন বের হয়। ড্রাইভার নিজে উঠে হুইলচেয়ার টাকে নির্দিস্ট সিটের দুটো বেল্ট এর সাথে আটকিয়ে দেয়। পাঁচ মিনিট দূরত্বে গেলেও ড্রাইভার কে ঊঠানামা দুইবারই এই কাজটা করতে হয়। এই প্রক্রিয়াটা আমি যেবার প্রথম দেখি, আমার খুব খুব মনটা খারাপ হয়েছিল। আমাদের দেশে সুস্থ মানুষই পথ চলতে প্রচন্ড কষ্ট হয় আর এইখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এমনকি রাস্তাগুলো তাদের চলার উপযোগী করে তৈরী করা। আমি এমন কোনো পাবলিক টয়লেট কিংবা পার্কিংলট এখনো পাইনি, যেখানে প্রতিবন্ধিদের আলাদা জায়গা নেই।

ওরিয়েন্টেশানের দিন ঘনিয়ে আসলো চোখের পলকেই। আমি সারাদিন অধির আগ্রহে ওর ফেরার অপেক্ষায় রইলাম,সারাদিন কি হল তা শোনার জন্য। ফল এ মাত্র ছয়জন পি এইচ ডি স্টুডেন্ট, ছয়জনের বাড়ি ছয়দেশে। বাংলাদেশ, ভারত (সে অবশ্য পরে আসেনি), চায়না, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া আর একজন আমেরিকান। এই গ্রুপটা এখন আমাদের দুইজনের জীবনে এমনভাবে মিশে গেছে, পরিবার, বন্ধুশুন্য এ শহর এখন আর আমাদের একা করতে পারেনা। পুরাই কসমোপলিটান একটা সার্কেলে শুরু হলো আমাদের আমেরিকান জীবনের পথচলা।

প্রথমদিন ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরেই বেশ টায়ার্ড ছিলো, তাই আমেরিকানদের মত সাতটার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে আমরা ঘুমিয়ে পরলাম (যদিও তখন ফকফকে দিনের আলো চারিদিকে)। গভীর রাতে দরজায় মৃদুটোকায় ঘুমভেঙ্গে গেলো। উনার কুম্ভকর্ন মার্কা ঘুম দেখে ভাবলাম হয়তো ভুল শুনেছি। কিন্তু কিছুক্ষন পর মৃদু-টোকা ধড়াম ধড়াম শব্দে রুপ নিলো। দুইজনেই প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। ঘড়িতে তখন প্রায় রাত দুটোর মত বাজে। নির্ঝর আমাকে বললো ফোন হাতের কাছে নাও, ৯১১ কল করতে হবে। আমি বললাম, আগে ডোর ভিউয়ারে দেখোনা কে আসছে। ফুটো দিয়ে দেখলাম, দুইটা বিশাল আকারের লাগেজের পাশে দাঁড়িয়ে, পিচ্চি একটা চীনা মেয়ে আকুল হয়ে কাদছে ………….

 


চির সবুজের রাজ্যে সিরিজের গল্পসমূহঃ

 পর্ব ১ঃ প্রারম্ভিকা

 পর্ব ২ঃ যাত্রা শুরুর দিনগুলি