প্রবাসে পর্ব ১ঃ যাত্রা পথের গল্প

ইমিগ্রেশন পার হলাম, আর কাউকে দেখা গেল না। আমার কাছে একটা ব্যাকপ্যাক। সেটা নিয়ে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে আছি। আশেপাশে অনেক ফরেনার ঘোরাঘুরি করছে। এত ফরেনার একসঙ্গে এর আগে দেখিনি। বুঝলাম একদল শ্রমিকও যাচ্ছে আমাদের সাথে। পুলিশ টাইপের কয়েকজন লোক আমাকে জেরা করল। তাদের সন্দেহের তালিকায় ছিলাম কিনা জানি না তবু সব উত্তর ভালভাবে দিলাম। ক্যা¤পাসের এক আপুর সাথে দেখা হল। উনিও আমেরিকা যাচ্ছেন। পরমানু শক্তি কমিশন থেকে একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে। এমিরেট্সেই যাচ্ছেন। আপুর সাথে গল্প হল অনেক। আপু জিজ্ঞেস করলেন, ভয় পাচ্ছিস? বললাম, হু। আপু আমাকে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। বার্গার টাইপ কিছু কিনলেন। এয়ারপোর্টে অনেক লোককেই দেখলাম খাওয়া দাওয়া করতে। অনেকেই রোজা ভাংছে। শুনলাম কালকেই ঈদ।

আমরা খেতে খেতে হাঁটছিলাম। একজন অফিসার এসে জেরা শুরু করলেন। আমি সব উত্তর ভালভাবে দিলাম। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে কাগজ পত্র দেখালাম। আপু কিছু দেখাতে চাইলেন না। জানালেন, তিনি উত্তর দিতে বাধ্য নন। তার কাগজ পত্র ইমিগ্রেশনে চেক করে, তবেই এখানে পাঠানো হয়েছে। অফিসারটিও ছলি নাছোড়।

– আমি ইমিগ্রেশন পুলিশ, আমার কাজ তদন্ত করা, আপনার কাগজে নিশ্চয়ই ঝামেলা আছে।
– থাকতে পারে। আপনি ইমিগ্রেশনে গিয়ে সেটা তদন্ত করুন। আমার কাছে নয়।
অফিসার বেশ রেগে গেলেন। তর্ক জমে উঠল, আমি ঝামেলার গন্ধ পেলাম। ইউনিফর্ম পরা একলোক এসে বললো, স্যার ওনার কাছে জি ও (গভারনমেন্ট অর্ডার) আছে। অফিসারটি মুখ শুকনা করে চলে গেল।
আপু জিজ্ঞেস করল, কিরে ভয় পেয়েছিলি?
– হু
-এদের আসলে কোন কাজ নেই, একা মেয়ে দেখলেই হ্যারাস করে।

প্লেনে উঠে পড়েছি আমি। আমার আর আপুর অনেক দূরে সিট। আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। আব্বু–-আম্মুকে ফোন করে বললাম, প্লেনে উঠেছি। এক সময় ফোন বন্ধ করতে হল। বিভিন্ন এনাউন্সমেন্ট ভেসে আসছিল। সেগুলো শুনছিলাম আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্লেন দেখছিলাম। একটা নব ঘোরালাম। একটা খাবার টেবিল বেরিয়ে এল। গ্লাস যাতে না পড়ে যায়, তার জন্য আলাদা একটা ফুটো দেখলাম। বাসে খাওয়ার সময়, খুব অসুবিধায় পড়তাম। কোথায় খাবার, পানির বোতল রাখব, এ নিয়ে ঝামেলা হত। এখানে সে সমস্যা নেই। অল্প স্থানে অনেক ব্যবস্থা; বেশ মুগ্ধ হলাম। একসময় সিট বেল্ট বাঁধার নির্দেশ আসল। একটি এয়ারহোস্টেস মেয়ে এসে পরীক্ষা করে গেল, সিট বেল্ট বেধেছি কিনা। মেয়েটিকে দেখে জীবনানন্দের লাইন মনে পড়ল।

“পৃথিবীর আর রাঙা রাজকন্যাদের মত সে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে”। আরও অনেক রাঙা রাজকন্যা দেখলাম। রাঙা রাজকন্যাতে প্লেন ভরে গেল একসময়। প্লেন ছেড়েও দিল হয়ত কোন রাজপুত্র। আমি মাটি থেকে উপরে উঠছি অনেক উপরে। মাটির মানুষের সাথে ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়ছে আমার। একসময় বিন্দুর মত হয়ে গেল সবকিছু। প্লেন আরও উপরে উঠছে। আমার কানে কানে বো বো আওয়াজ ভেসে আসছে। ভাবছিলাম, আর কত উপরে উঠবো আমরা! পুরা বাংলাদেশটা নিশ্চয়ই দেখা যাবে। এক সময় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দখো গলে না।

আমি ফুঁপিয়ে কাঁদছি। আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক রাঙা রাজকন্যা। হাতে গরম রুমাল। দেখলাম বাকিরা ওটা দিয়ে হাত মুছল, আমিও মুছলাম। প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছি। সব অন্ধকার আর কিছু তারা দেখা যাচ্ছিল। প্লেনে দেওয়া, খাবার খেলাম। মোটামুটি মনে হল। আর কখন খাবার দিবে, এই ভয়ে সব খাবার খেতে হল ।

দুবাই পৌঁছে গেছি। সিট বেল্ট খুলতে হবে, কিছুতেই খুলতে পারছিনা, এদিক না ওদিক, বুঝে উঠতে পারছিনা। এক সুদর্শন আরব্য যুবক এসে খুলে দিল। লাগেজ নিয়ে ইমিগ্রেশনে দাঁড়ালাম। ভারী ব্যাগ তুলতে পারছি না। সেই ছেলেটিই তুলে দিল। দেখি, সে পিছনেই ছিল, তাড়াহুড়ায় ধন্যবাদ দেওয়া হল না। চেক ইন করলাম। তারপর ছেলেটির কথা খেয়াল হল। আমার অবচেতন মন ওকে অনেক খুঁজল কন্তিু কোথাও দেখলাম না। আপুকেও খুঁজলাম, তাকওে পেলাম না। এবার আমি আমেরিকা যাবার প্লেনে। এই জার্নিটা ছিল ভীষণ লম্বা আর ক্লান্তিকর। প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে অবশেষে আমেরিকা পৌঁছেছি। টেক্সাসের ডালাসে ইমিগ্রেশনে দাঁড়িয়ে। ভীষণ লম্বা লাইন। আমার আশেপাশে অনেক মেয়ে দাঁড়িয়ে। সবাই খুব ছোট ছোট প্যান্ট পরা আর ভীষণ ফর্সা পা বেরিয়ে আছে তাদের।

ইমিগ্রেশন পার হয়ে আসলাম। আট ঘণ্টা পর পরবর্তী ফ্লাইট। গন্তব্য সাউথ ডাকোটা। সাউথ ডাকোটায় সাজ্জাদকে ফোন করলাম। সাজ্জাদ আমার ব্যাচের, একই ক্যা¤পাসের। ফোন করতে কয়েন লাগে।আমার কাছে কয়েন ছিল না, একজন সাহায্য করল। হঠাৎ খুব খিদে পেল। দুই ডলার দিয়ে একটা চিপ্স কিনলাম। কেনার পরমাত্রই দুই ডলার এর গুরুত্ব মাথায় আসল। দুইকে চুরাশি দিয়ে গুন করে প্রকৃত দাম বের করে ফেললাম।

একজন ব্লাক আমেরিকান পুলিশের সাথে পরিচয় হল, নাম স্ট্যানলি। স্ট্যানলি অনেক গল্প করল। এজন্য মনে মনে আমাকে অনেক ইংরেজি অনুবাদ করতে হল। তার গল্পে রীতিমত হাঁপিয়ে গেলাম। সে আমার ইমেইল এড্রেস নিল। স্ট্যানলি চলে গেল। যদি হারিয়ে যাই এই ভয়ে আর এয়ারপোর্ট থেকে বেরুলাম না। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভেঙ্গে খুব ভয় হল। প্লেন ছেড়ে দেয়নি তো? রাতে কোথায় থাকব, আবার কি প্লেন ফেয়ার দিতে হবে? এই সব ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলাম। দেখি, প্লেনে বোর্ডিং শুরু করেছে।

আমি প্লেনে উঠেছি। প্লেন ছেড়ে দিল। আমি রাতের টেক্সাস দেখলাম। ভীষণ আলো ঝলমলে শহর, দুবাইতেও দেখেছি। একটা ফ্লাই ওভার এর লুপ দেখেছিলাম বাংলায় চার এর মত। ছোট ভাইকে এ বিষয়ে কি কি গল্প করব, সেগুলো সাজালাম।

রাত সাড়ে এগারোটা।
আমি এখন সাউথ ডাকোটা স্যুফলস এয়ারপোর্টে। আমার লাগেজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বিমর্ষ চিত্তে বসে আছি। ইউনিভার্সিটি থেকে দুজন, আমাকে আর কিছু ছাত্রকে নিতে এসেছে। ওরাই দৌড়াদৌড়ি করছে লাগেজের জন্য। আমি লাগেজের জিনিসপত্র কিনতে কত টাকা লাগবে, কি কি না কিনলেও চলে এই হিসেব করছি।


প্রবাসে সিরিজের গল্পসমূহঃ

 পর্ব ১ঃ যাত্রাপথের গল্প
 পর্ব ২ঃ নতুন বাসা, ওরিয়েন্টেশন, রাস্তা হারানো
 পর্ব ৩ঃ পুলিশ আসা, রেজিস্ট্রেশন বিড়ম্বনা
 পর্ব ৪ঃ ডরমেটরির গল্প, প্রথম তুষারপাত
 পর্ব ৫ঃ ইন্টারন্যাশনাল নাইট, বাসা নিয়ে ঝামেলা, শায়লা আপুর চলে যাওয়া
 পর্ব ৬ঃ কামরানকে হাসপাতালে নেওয়া, টেকো সুদীপ আর ব্রিটিশ প্রফেসরের গল্প
 পর্ব ৭ঃ ল্যাব ও ফরাসী যুবকের হৃদয় ভাঙার গল্প
 পর্ব ৮ঃ সামার এসেছে, বেতন পাইনি, প্রথম বাসা ছেড়ে দিলাম
 পর্ব ৯ঃ সঙ্গীহীন জীবন, সুরিয়া মথুর গল্প, সামারের দিনলিপি, একা পথ চলা
 পর্ব ১০ঃ বিদেশী ভাষা শেখা ও আমেরিকান চাষাবাদের গল্প
 পর্ব ১১ঃ আমার বাইবেল শেখা
 পর্ব ১২ঃ সাজ্জাদের চলে যাওয়া, লিবিয়ান পরিবারের গল্প
 পর্ব ১৩ঃ মুহিত ভাইয়ের গল্প, আমার আগুন ধরিয়ে ফেলা
 পর্ব ১৪ঃ মসজিদ, ঈদ, ইয়ামিনী আসা, নতুন বাসা, আমেরিকান বিয়ে ও অরিগন যাবার গল্প
 পর্ব ১৫ঃ
 পর্ব ১৬ঃ
 পর্ব ১৭ঃ
 পর্ব ১৮ঃ
 পর্ব ১৯ঃ

লেখক পরিচিতিঃ

 জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ ক্যারোলিনা এ এন্ড টি স্টেট’ ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ‘PhD’ করছেন এবং তার গবেষণার বিষয় হল ‘Real time Object detection with Higher Accuracy’। jannatunজান্নাতুন নাহার তন্দ্রার স্কুল জীবন কেটেছে চুয়াডাঙ্গা শহরে, কলেজ জীবন হলিক্রস কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। এবং সেখান থেকেই ২০১০ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষে ২০১২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং ২০১৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা অবসরে লিখতে ভালবাসেন এবং সে অভ্যাস বশতই আমেরিকার গ্রাজুয়েট প্রোগামে একা একটি মেয়ে পড়তে আসার অভিজ্ঞতা (সাউথ ডাকোটা) একসময় তিনি লিখতে শুরু করেন। এবং তার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘প্রবাসে’ নামে ২০১৫ সালের ‘একুশে বই মেলায়’ তার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি কোন তথ্যমূলক বই নয় বরং বলা যায় এটি লেখিকার রোজকার ডায়েরী।