খাটটি পেয়ে আমার সারাদিন শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আগের বাসায় ম্যাট্রেস ছিল। বাসা ছাড়ার সময় বাড়ীয়ালাকে ফেরত দিতে হয়েছে। ম্যাট্রেসগুলোয় উনি ফ্রি থাকতে দিয়েছিলেন। ওটি তার সামার ক্যাম্পিং এ লাগে। আমেরিকায় ক্যাম্পিং খুব জনপ্রিয়। সামার আসলেই ঘরবাড়ি ফেলে এরা বনে বাদাড়ে চলে যায়। সেখানে কিছুদিন তাঁবু খাটিয়ে থাকে। বন জঙ্গল অসহ্য মনে হলে আবার লোকালয়ে ফিরে আসে।

সুরিয়ার বাসায় এতদিন ওর সোফায় ঘুমিয়েছি। সুরিয়া অবশ্য যেদিন আসি সেদিন আমাকে বলেছিলো, এখানে তুমি খুব আরামে ঘুমাবে। মথু যখন থাকত, মথু ঘরে আর আমি লিভিং রুমে এই সোফাটাতে ঘুমাতাম।

সুরিয়াদের আগের এপার্টমেন্টে; আরও অনেকের সাথে ওরা একটি রুম নিয়ে থাকতো। সুরিয়া বললো, তখন ও নাকি তারা আলাদা ঘুমাতো। মথু উপরে খাটে আর সে নিচে মেঝেতে। আর ও বললো, একি ঘরে থাকলে কি হবে, জানো মথু কিন্তু এখনও আমাকে ছোঁয়নি। মথু আসলেই খুব ভদ্র ছেলে ছিল। সুরিয়া ও খুব ভদ্র মেয়ে। আমি কখনই ওদের সম্পর্ক নিয়ে কোন প্রশ্ন করিনি। তবু সুরিয়া আমাকে কেন এত কিছু বললো বুঝলাম না।

রাতে নাসরিনের সাথে যখন কথা হল। ওকে বললাম, আমরা বাইরে থেকে যা ধারণা করি তা সবসময় ঠিক নয়। সুরিয়া আমাকে আজ সবটা বলেছে। নাসরিন বললো, তাই নাকি? এসব গল্প সুরিয়া কোনোদিন আমাকে করে না। তোমার মতো গাড়লদেরকেই শুধু করে। আমি যে সুরিয়ার কথা শতভাগ বিশ্বাস করেছিলাম তা নয়। তবে নাসরিনে আমাকে গাড়ল বলাতে বেশ রাগ হল।

যাই হোক খাটটি পেয়ে আমি খুব আরাম করে ঘুমুচ্ছিলাম। নিজের একটা খাট, নিজের একটা বিছানা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিল। দিনের বেলা ল্যাবে গিয়ে কাজ করতাম আর ভাবতাম কখন বাসায় যেয়ে খাটে গড়াগড়ি দেবো।

এর মাঝে প্রফেসর মনে করিয়ে দিলেন ১৩ই জুলাই ল্যান্ডস্যাট ক্যালিব্রেসন মিটিঙের কথা। স্যু ফলসে, ইরসে হবে মিটিং। ইরস হল আর্থ রিসোর্স অব্জারভেশন সেন্টার। সহজ কথায় স্যাটেলাইট ডাটা যেখানে জমা হয়। মিটিংটা ছিল নাসা, আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠানের কম্বাইন্ড মিটিং। মিটিং এ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আমরা। প্রফেসর বললেন, আমরা সকাল ৬টায় রওনা দেব। ৬টার মধ্যে সবাই যেন চলে আসে। মিটিং এ ব্রেকফাস্ট থাকবে তবে কোন লাঞ্চ দেওয়া হবে না। বাড়ি থেকে খাবার আনতে পার অথবা কিনতে পারো। খাবার একটু এক্সপেন্সিভ হতে পারে। আমি একটু অবাকই হলাম। এত আয়োজন, এত প্রস্তুতি। খাবারই দেবে না! সে আবার কি রকম মিটিং। আমাদের দেশে মিটিং মানেই তো খাওয়া দাওয়া।

ঐ দিন ভোরে উঠে লাঞ্চ বানিয়ে ডিপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এত ভোর, আমার ধারণা ছিল, রাস্তা ঘাট সব ফাঁকা। কিন্তু দেখলাম না ভালই গাড়ি চলছে। সর্টকাট করতে আমি ভিতরের রাস্তা দিয়ে গেলাম। ভিতরের রাস্তায় কেউ নেই আর ভোর পাঁচটা, তাই সূর্যের আলোও ততটা ফোটেনি। ভিতরের রাস্তায় এক বাড়ি ছিল। তার সামনে একটা ভাঙ্গা গাড়ি। মনে হয় কেউ থাকেনা। একদিন সন্ধ্যায় এক থুত্থুরে বুড়িকে ঐ বাড়ির বারান্দায় বসে থাকতে দেখেছি। বুড়িকে আমার গল্পের সেই ডাইনী বুড়ির মত মনে হয়েছিল। আমি জোরে পা চালাচ্ছিলাম। আমার শুধু মনে হচ্ছিল এই বুঝি বুড়ি বেরিয়ে এসে আমার ঘাড় মটকে দেবে। ডিপার্টমেন্ট পৌঁছে দেখি পুরো ঘেমে গেছি। কাপড় চোপড় পাল্টে অনেক্ষন ধরে সাজগোজ করলাম।

৬টা বাজে আমরা রওনা দিয়েছি। আমাদের গাড়ি চালাচ্ছিলেন প্রফেসর এরন। সাতজন বসা যায়। বেশ বড় গাড়ি। পিছনের সিটে আমি আর মারকট বসলাম। পথে যেতে যেতে অনেক ফসলের মাঠ পড়ল। সূর্যের আলো তখন কিরণ ছড়াতে শুরু করেছে। খুব চমৎকার লাগছিলো দেখতে। বেশীর ভাগই সব গম, যবের ক্ষেত। আমেরিকার ফসল সম্পর্কে গল্প হচ্ছিল। জানলাম ভৌগোলিক কারণে এখানে মসলার চাষ হয় না। এই কারণে আমেরিকান খাবারে মসলা থাকেনা। যেখানে যেটি হয় তাদের তো সেটি খেয়েই অভ্যস্ত হওয়ার কথা। তবে আমেরিকানরাও এখন মসলা খাওয়া শুরু করেছে। প্রধানত মেক্সিকো ও আরও অনেক দেশ থেকে মসলার আমদানি করা হয়। এক ঘণ্টা পর আমরা ইরস পৌছালাম। তার আগে আমাদের সিকিউরিটি চেক করা হল। ল্যারি নিজেই বললো, খুবই হাস্যকর এসবের কোন মানে হয়। ইরসে আছেটা কি, টেররিস্টরা কেন আসবে এখানে?

চার-পাঁচ মাস আগে প্রফেসর এরন একবার জিজ্ঞেস করছিলেন, ডু ইউ নো মুহিত ফ্রম বাংলাদেশ? এর আগে তিনি আমাদের গার্মেন্টস পুড়ে যাওয়া নিয়ে অনেক গল্প করছিলেন। তখন মনে হয়েছিল, বাহ্ উনি আমার দেশের অনেক খবরই রাখেন। আর বাংলাদেশের আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে তো সবাই চেনেই।

আমি বললাম, ইয়েস আই নো হিম ভেরি ওয়েল। হি ইজ দা মিনিস্টার অফ আওয়ার কান্ট্রি। তিনি বললেন, ওহ রিয়েলি! একচুয়ালি হি ওয়াজ মাই স্টুডেন্ট। আমার উত্তর শুনে অনেকক্ষণ হাসলেন উনি আর ঘটনাটি আমি ভুলেও গেলাম।

আমাদের পিছনে আর একটি গাড়ি চেকের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু তাদেরকে আগে যেতে দেওয়া হল। ডক্টর হেল্ডার বললেন গাড়িতে মুহিত আছে। নামটা আমার খুব চেনা মনে হল। কোথায় যেন শুনেছি এ নাম। যাই হোক আর কতগুলি চেক পেরিয়ে আমরা ইরসে ঢুকলাম। মিটিং শুরু হওয়ার আগে সবাই খাওয়াদাওয়া করছে। ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছে। ব্রেকফাস্ট এত পরিমাণে দেওয়া হয়েছে যে লাঞ্চ করার আর দরকার নেই।

কিন্তু সময় কম আর গপগপ করে খেয়ে পেট ভরিয়ে রাখলে ভাল দেখায় না। আমি শুধু একটি আপেল নিলাম। মিটিং শুরু হল। চারদিক পিনপতন নীরবতা। খুব আস্তে করে আমি আপেলে কামড় দিচ্ছিলাম যাতে আমার আপেলের কামড়ে মিটিঙের কোন অসুবিধা না হয়। কিন্তু সেই আস্তেটাতেই মনে হলো যেন অনেক শব্দ হচ্ছে। পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে যাচ্ছে। নিশ্চিত হতে পাশে বসা সুদীপকে বললাম, দেখোতো আমি আপেল খেলে তুমি কোন কচকচ শব্দ শোনো কিনা। সুদীপ বললো, হুম হাল্কা কচকচ শোনা যাচ্ছে। আপেল খাওয়া বাদ দিয়ে আমি মিটিঙে মন দিলাম।

আমাদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল। আমার পরিচয় যখন দিল তার আগ পর্যন্ত আমার ধারণা ছিলনা যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আমার ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। বিদেশে প্রফেসররা অবশ্য এভাবেই কথা বলেন। নাউ ইউ আর দ্যা ইনচার্জ অফ দিস প্রজেক্ট। ইউ আর দ্যা সাইন্টিস্ট। উই অল আর সাইন্টিস্ট হেয়ার …। এরকম আরও অনেক কিছু। এই অনেক কিছুর কারণে যেটি হয়, যে ছেলেটি মনে মনে ফাঁকি দেওয়ার পরিকল্পনা আঁটছিল। একসময় তার মনে হয়, সত্যিই কি আমি সাইন্টিস্ট না? চাইলে কি আমিও কিছু করতে পারি না।

এই কিছু করার জন্য ছেলেটি দিনরাত কাজ করে। কাজ না করে অবশ্য এখানে উপায়ও নেই। ফায়ার করতে এরা ওস্তাদ। তবে ফায়ার এরা ফায়ারিং মুডে করে না। চোখে জল আনার মত করে বলে দেখ আমি তোমাকে এ বছর সাপোর্ট দিতে পারছি না। আসলে আমার সে সুযোগ নেই। ফান্ডের অবস্থা ভাল নয়। আমার খুব খারাপ লাগছে এ জন্য। তোমাকে সাপোর্ট দিতে পারলে এ মুহূর্তে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হতাম …। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেটি হয়, আসলে সে বড় অঙ্কের ফান্ড পেয়েছে। তোমাকে দিয়ে সে তার আউটকাম পায়নি বলে এই কৌশল। তবে খারাপ ভাবে কখনই এরা বলবে না, খারাপ ব্যবহার করবে না। কারো মনে কষ্ট দেওয়া আমেরিকানদের কাছে প্রচণ্ড অমানবিক ব্যাপার। কিন্তু হৃদয় ভেঙে খান খান করা, পায়ের তলার মাটি কেড়ে নেওয়া সামান্য ব্যাপার।

মিটিঙের লোকজনের অধিকাংশই ছিল নাসার ক্যালিব্রেসন সাইন্টিস্ট, ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আর কয়েকজন ইরস ইমপ্লয়ী। আমার চোখ শুধু খুঁজছিল এদের মধ্যে কোন বাংলাদেশি আছে কিনা। হুইল চেয়ারে বসা একজনকে দেখলাম। তাকে আমার বাংলাদেশি মনে হল। ইরস ইমপ্লয়িদের যখন পরিচয় দেওয়া হল। জানলাম তার নাম মুহিত এবং নিশ্চল আমাকে বললো, হি ইজ ফ্রম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নামটা শুনে আমার আবেগে আপ্লুত হওয়ার কথা কিন্তু মুহিতকে দেখে ততক্ষণে আমি নিশ্চিত হয়ে গেছি এই মুহিতের কথায় প্রফেসর  বলেছিলেন। কিন্তু সেই মুহিত এমন হতে পারে সেটি আমার ধারণার ভীষণ বাইরে ছিল। মুহিতকে আমি এখানে ভাই বলে সম্বোধন করাটা সমীচীন মনে করছি। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মুহিত ভাইকে দেখছিলাম। মিটিং এর কিছুই আমার মাথায় ঢুকছিল না।

মুহিত ভাইয়ের বর্ণনা কিভাবে দেব ঠিক বুঝতে পারছিনা। এর জন্য সত্যি ক্ষমা চাচ্ছি। মুহিত ভাই একটি হুইল চেয়ারে বসে আছেন, হাত পা নড়াতে পারছেন না। হাতের সাথে একটা শক্ত লাঠির মত বেঁধে রেখেছেন। সেটা দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পাসওয়ার্ড টাইপ করলেন। ভাবছিলাম, যদি পাসওয়ার্ড টাইপ করতে এতক্ষন লাগে তাহলে উনি কি করে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চাকরি করছেন! এত এত কাজ কি করে করছেন! একজন বললো একটা ভয়েস ট্রান্সলেটর দিয়ে  নাকি উনি কাজ করেন। তবে ওনার প্রেজেন্টেশনের সময় মনে হল, কথা বলতেও ওনার বেশ কষ্ট হচ্ছে।

মাঝখানে আমাদের টি ব্রেক দেওয়া হল। আমি মুহিত ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম। নিজের পরিচয় দিলাম। আমাকে খুব সহজেই তুমি করে বলা শুরু করলেন। একজন বাংলাদেশি পেয়ে উনিও যেন বেশ আনন্দিত। বেশ হেসে হেসে কথা বলছিলেন। চমৎকার করে হাসেন উনি। আমার ধারণা ছিল মুহিত ভাই নিশ্চয়ই আমার বছর সাত আট বছরের সিনিয়র হবেন। কিন্তু তার ব্যাচ শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হবার অবস্থা। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। যত দূর মনে পড়ে  ‘৮৯ এর ব্যাচ। কিন্তু তাকে দেখলে সেটি মনে হবার কোন কারণ নেই। গৌর বর্ণের মুখ খানায় চমৎকার হাসি যেন তাকে চির তরুণ করে রেখেছে। এই চির তরুণটি যখন আমার সাথে কথা বলছিলেন। এই দীর্ঘ কথা বলার সময় একবারও ঘাড় নড়াননি। সেটি কোন লজ্জা বা ইচ্ছাকৃত কারণে নয়। মুহিত ভাই ঘাড় নড়াতে পারেন না।

বছর কয়েক আগে বন্ধুদের সাথে এক আলো ঝলমলে দিনে মুহিত ভাই ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। তখন তাদের গাড়িতে একটা এক্সিডেন্ট হয়। মুহিত ভাইয়ের বাকি বন্ধুদের তেমন কিছু না হলেও সেই আলো ঝলমলে দিনে তার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। তবে তার নিজ কর্মগুনে সেই অন্ধকার তিনি সরিয়ে ফেলেছেন। তার নির্মল হাসি, উপস্থাপন দেখে আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে।

কলেজে থাকতে আমার এক বন্ধু ছিল ওর নাম প্রিয়াঙ্কা। পরে ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে চলে যায়। আমরা বন্ধুরা একদিন গল্প করছিলাম। এক বন্ধু একটা লোকের গল্প বলছিল, লোকটা অমুক পারে, তমুক পারে তবে ঘাড় নড়াতে পারে না। হঠাৎ প্রিয়াংকা চেঁচিয়ে ঊঠলো, তাহলে লোকটা বেঁচে আছে কেমন করে? আমি বললাম, না বাঁচার কী আছে? না লোকটা তো আকাশ দেখতে পারে না, আকাশ না দেখে কেউ বাঁচে কিভাবে? মুহিত ভাইকে দেখে প্রিয়াংকার কথাটা মনে পড়ে গেলো। আকাশ নিয়েই যার কাজ, সেই কিনা আকাশ দেখতে পারে না।

লাঞ্চ টাইমে আমি টুনা সালাদ কিনলাম। সবার সামনে বক্স খুলে খাব ভেবে অদ্ভুত লাগছিল। সুদীপ বললো তুমি না খাবার এনেছ? আমাকে দাও। সুদীপকে নুডুলস দিয়ে আমি মুহিত ভাইয়ের কাছে গেলাম। দেখলাম তার আমেরিকান সহকর্মীরা তার খাবার এনে দিচ্ছে। খাওয়া শেষে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। আর কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করছে। করুণা করে নয়, খুব সম্মানের সাথেই করছে। বুঝলাম আমেরিকান চাকরীর এই ‘এনি টাইম হায়ার এনি টাইম ফায়ার’ বাজারে মুহিত ভাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চয়ই তিনি আমেরিকানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

কিন্তু আমার প্রশ্ন ছিল এতো শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন কি করে! শুনেছি মুহিত ভাই স্যু ফলসের একটা বিশেষ ফ্ল্যাটে থাকেন। শারীরিক ভাবে অসুবিধাগ্রস্থ লোকদের জন্য এই ফ্ল্যাট। চব্বিশ ঘণ্টা নার্স থাকে সেখানে। অফিসে আসার সময় এক আমেরিকান সহকর্মী ওনাকে রাইড দেন।

আমেরিকানদের প্রতি আমার মাঝে মাঝে খুব রাগ হত। তাদেরকে অমানবিক, নির্দয়, নিষ্ঠুর মনে হত। কিন্তু সেদিন যেন বারবার ওদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞই হচ্ছিলাম। মিটিং থেকে ফিরতে আটটার মত বেজে গেল। তখনও কটকটা রোদ। ল্যারি আমাকে বাসায় পৌঁছে দিল। পরদিন ল্যাবের সাপ্তাহিক মিটিং। ল্যারি আমাকে বললো, তুমি কি প্রতিদিন এত দূর হেঁটে আস?

– হুম।

ডক্টর হেলডার বললেন, কেন তোমার গাড়ি নেই?

– নেই।

ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই?

-নেই।

সাইকেল আছে?

-আছে, তবে চালাতে পারি না।

একটা মানুষ সাইকেল চালাতে পারে না, উনি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বললেন, তাহলে তুমি তোমার দেশে কি করতে? সাইকেল চালাতে পার না, গাড়ি চালাতে পার না। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিতে নাকি সবসময় এখনকার মত হাঁটতে? আমি বললাম, না হাঁটতাম না। প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট নিতাম, ওটার নাম রিক্সা। আমাদের দেশের মানুষ তোমাদের মত এত হাঁটে না। বুঝিয়ে বললাম, রিক্সা খুব ভাল ট্রান্সপোর্ট। ওটা তোমাকে বাসার সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। ওটাতে খুব হাওয়া হয়। ওটাতে চড়লে তোমার মন ভাল হয়ে যাবে, কখনও বমি পাবে না। যেহেতু মাত্র দুজন বসা যায় এবং বেশ ঝাঁকুনি হয় তাই তুমি ওটাতে ডেটও করতে পার। ঝাঁকুনির সুবিধা, তুমি মাঝে মাঝে না চাইতেই অপরপক্ষের ছোঁয়া পাবে।

– ওহ্ ইট’স রোমান্টিক।

ইয়েস।

– হুম, তবে চিন্তা কর না জান্নাতুন। রায়ান তোমাকে এখন থেকে সাইকেল চালানো শেখাবে।

পরদিন ল্যাব শেষে রায়ান দেখি দাঁড়িয়ে আছে। বললো চল, তোমাকে সাইকেল চালানো শেখাই। বললাম, দেখো এই বুড়ো বয়সে এই শিখে হাত পা ভাংতে চাই না। রায়ান হাসতে হাসতে বললো, হাউ ওল্ড আর ইউ? এক বছর কমিয়ে বললাম। বললো, রিয়েলি? তোমাকে তো অনেক ইয়াং দেখায়। রায়ানের মন্তব্যে ভীষণ খুশি হলাম আমি।

এরপর ও বললো, আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল তুমি কখনও এশিয়ানদের বয়স অনুমান করতে পারবে না? তাদেরকে আসল বয়সের থেকে অনেক ইয়াং দেখায়। রায়ানের কথায় খুব রাগ হল আমার।

এর মধ্যে আমি এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললাম। আমার কিছুটা ভুলে যাওয়া রোগ ছিল। সেদিন চুলায় মুরগী রান্না করব বলে তেল গরম দিলাম। দিয়ে মেঝেতে কি যেন একটা পড়েছিলো, সেটা পরিষ্কার করছিলাম। পরিষ্কার করতে করতে চুলায় যে কিছু দিয়েছি বেমালুম ভুলে গেলাম। আমি যখন ঘষে ঘষে মেজেটা তকতকে করছি, সুরিয়া চিৎকার দিয়ে উঠল ফায়ার ফায়ার। ততক্ষণে ফায়ার এলার্ম বাজতে শুরু করেছে।

সেদিন তেল একটু বেশিই ঢেলেছিলাম পুরা সপ্তাহের রান্নার জন্য। তেল পুরাটা পুড়ে শেষ না হলে আগুন নিভবে না। তেলের আগুন পানিও দিতে পারছিনা। কিন্তু বাসা তো কাঠের এর মধ্যে আগুন ধরে যেতে পারে। সুরিয়া বললো, আগে চুলাটা নিভাও। কিন্তু ভয়ে ও বস্তুর কাছে আমি যাচ্ছি না। সুরিয়াই চুলা নিভিয়ে গনগনে পাতিলটাকে মেঝেতে রাখল। তখনও দাও দাও করে আগুন জ্বলছে। সুরিয়া একটা চেয়ার নিয়ে গেল ফায়ার এলার্ম খুলতে। কিন্তু কিছুতেই সে পারছিলনা। তখন রাত ১২ টা বাজে। আমাদের ভয় হচ্ছিল ফায়ার ব্রিগেড না চলে আসে। আমাদের কলিং বেল ক্রমাগত বাজছে। বুঝতে পারছিলাম না, ফায়ার ব্রিগেডের লোক কিনা। দরজা খুলে দেখি, এপার্টমেন্টের সবাই চলে এসেছে। ভীষণ ফোলা আর উৎকণ্ঠা তাঁদের চোখে। আমেরিকানরা সাধারনত রাত আটটা নটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। আগুন ধরেছে ভেবে তারা কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে ছুটে এসেছে।

একজন বললো, ডু ইউ হ্যাভ ফায়ার ইন ইওর হোম? ডু ইউ নিড টু কল ৯১১?

আমরা বললাম, কই নাতো, সেরকম কিছু নয়। বিকট শব্দ করে ফায়ার এলার্ম তখনও বাজছে।

 


প্রবাসে সিরিজের গল্পসমূহঃ

 পর্ব ১ঃ যাত্রাপথের গল্প
 পর্ব ২ঃ নতুন বাসা, ওরিয়েন্টেশন, রাস্তা হারানো
 পর্ব ৩ঃ পুলিশ আসা, রেজিস্ট্রেশন বিড়ম্বনা
 পর্ব ৪ঃ ডরমেটরির গল্প, প্রথম তুষারপাত
 পর্ব ৫ঃ ইন্টারন্যাশনাল নাইট, বাসা নিয়ে ঝামেলা, শায়লা আপুর চলে যাওয়া
 পর্ব ৬ঃ কামরানকে হাসপাতালে নেওয়া, টেকো সুদীপ আর ব্রিটিশ প্রফেসরের গল্প
 পর্ব ৭ঃ ল্যাব ও ফরাসী যুবকের হৃদয় ভাঙার গল্প।
 পর্ব ৮ঃ সামার এসেছে, বেতন পাইনি, প্রথম বাসা ছেড়ে দিলাম
 পর্ব ৯ঃ সঙ্গীহীন জীবন, সুরিয়া মথুর গল্প, সামারের দিনলিপি, একা পথ চলা
 পর্ব ১০ঃ বিদেশী ভাষা শেখা ও আমেরিকান চাষাবাদের গল্প
 পর্ব ১১ঃ আমার বাইবেল শেখা
 পর্ব ১২ঃ সাজ্জাদের চলে যাওয়া, লিবিয়ান পরিবারের গল্প
 পর্ব ১৩ঃ মুহিত ভাইয়ের গল্প, আমার আগুন ধরিয়ে ফেলা
 পর্ব ১৪ঃ মসজিদ, ঈদ, ইয়ামিনী আসা, নতুন বাসা, আমেরিকান বিয়ে ও অরিগন যাবার গল্প
 পর্ব ১৫ঃ
 পর্ব ১৬ঃ
 পর্ব ১৭ঃ
 পর্ব ১৮ঃ
 পর্ব ১৯ঃ

লেখক পরিচিতিঃ

 জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ ক্যারোলিনা এ এন্ড টি স্টেট’ ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ‘PhD’ করছেন এবং তার গবেষণার বিষয় হল ‘Real time Object detection with Higher Accuracy’। jannatunজান্নাতুন নাহার তন্দ্রার স্কুল জীবন কেটেছে চুয়াডাঙ্গা শহরে, কলেজ জীবন হলিক্রস কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। এবং সেখান থেকেই ২০১০ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষে ২০১২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং ২০১৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা অবসরে লিখতে ভালবাসেন এবং সে অভ্যাস বশতই আমেরিকার গ্রাজুয়েট প্রোগামে একা একটি মেয়ে পড়তে আসার অভিজ্ঞতা (সাউথ ডাকোটা) একসময় তিনি লিখতে শুরু করেন। এবং তার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘প্রবাসে’ নামে ২০১৫ সালের ‘একুশে বই মেলায়’ তার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি কোন তথ্যমূলক বই নয় বরং বলা যায় এটি লেখিকার রোজকার ডায়েরী।