সকালে উঠে দেখি রিমি আপু অফিস চলে গেছেন। রাশেদ ভাই অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন। রাশেদ ভাই আমাদের নাস্তাটাস্তা গুছিয়ে দিলেন। আমরা একে একে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সারলাম। ফ্রেশ হতে একটু দেরি হল। একটি মাত্র বাথরুম, মানুষ অনেক। আমেরিকানদের বাসায় বাথরুম সচারচর একটি থাকে। কদাচিৎ দুটি দেখা যায়। আমার ধারণা আমেরিকানরা বাথরুমের কাজ বাইরেই সারে। এখানকার পাবলিক টয়লেট খুব ভাল। ভীষণ চকচকে, দেখলেই বসে যেতে ইচ্ছে করে।

আমাদের রওনা দিতে বেশ দেরি হল। ওদিকে অন্যরা আগেই রওনা দিয়েছে।  খাবার জন্য স্ন্যাকসও নিয়ে নিয়েছে। আমাদের এবারের গন্তব্য মাল্টনোমা ফলস। আমি ইমরান ভাইয়ের গাড়িতে। ব্যাচেলররা রাশেদ ভাইয়ের গাড়িতে। আর অনেকেই আজ নেই । প্রফেসর এর কাছ থেকে ছুটি পায়নি  বলে চলেও গেছে। আমাদের গাড়ি পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে ছুটছে। ইমরান ভাই আমার সাথে খুব  গল্প করছেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ক্যাম্পাসের গল্প শুনছেন। আমাদের গল্পে হাসির তেমন কিছু নেই। তবুও আয়শা ভাবী হেসে হেসে কুটি কুটি হচ্ছেন। ওনার এক একটা হাসির দমকে গাড়ি মনে হচ্ছে ছিটকে পড়বে এক্ষুনি। আর আমরা গভীর খাদে পড়ে যাব।

আমরা মাল্টনোমা ফলসে পৌঁছে গেছি। এটি আমেরিকার সবচেয়ে বড় ফলসগুলোর মধ্যে একটি। প্রচণ্ড ধারায় জল প্রপাত হচ্ছে।  উচ্চতা ৬২০ ফুট। প্রচুর পর্যটক। আমরা অনেক ছবি তুললাম।

সবাই কেমন জানি আলাদা আলাদা হয়ে গেছে। অনেক মানুষ পাহাড়ের উপর উঠছে। বুঝলাম ওরা জলপ্রপাতের উৎসটা কোথায় দেখতে চাচ্ছে।

জীবনে প্রথমবার হাইকিং করছি। সাথে অনেক মানুষ। এদের কাউকেই চিনিনা। হাইকিঙের ঢালে কিছুদূর পর পর অনেকগুলো নাম্বার আছে। নাম্বারগুলো দূরত্ব বোঝানোর জন্য, কে কত দূরত্ব পর্যন্ত যেতে পারছে। প্রতিটি নাম্বারে বিশ্রামের জায়গা। বিশ্রামের জায়গা থেকে কলম্বিয়া নদী দেখা যাচ্ছে। আমি পাহাড়ে উঠছি।  সাবধানে উঠছি। অসাবধান  হলে সোজা পাশের খাঁদে। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছি। কলম্বিয়া নদী দেখছি। আর নদীর সৌন্দর্যে বিষণ্ন হচ্ছি।

পাঁচ নাম্বার পয়েন্ট অতিক্রম করার পর আমার ভয় হতে লাগল। উঠছি কিন্তু নামতে পারব তো। তখনি বিষণ্ন একজনকে দেখলাম, নদী দেখছেন। তিনি ফরহাদ ভাই। ফরহাদ ভাই বললেন, হাঁপিয়ে গেছি। বিশ্রাম নিচ্ছি। মারুফ, অনিক ওরাও উঠছে। ওদের সাথে দেখা হবে ভেবে এতদুর  আসলাম। দেখা হল না। মনে হয় অন্যদিক দিয়ে উঠছে। ফরহাদ ভাই নেমে যাচ্ছেন। বললেন, কার সাথে এসেছো? একা শুনে বললেন, আমি নেমে যাচ্ছি। আমার সাথে নামতে পার।

আমি পয়েন্ট ছয়ের দিকে যাচ্ছি। ঢাল ক্রমাগত খাড়া হচ্ছে। আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। আমার পিছনে ফরহাদ ভাইও আসছেন। ফরহাদ ভাইকে বলছি নেমে যেতে কিন্তু আমাকে একা ফেলে উনি নামবেন না। ফরহাদ ভাইকে খুব দায়িত্ববান মনে হচ্ছে। মেয়েরা যে রকম দায়িত্ববান চায় সেরকম কিনা বুঝতে পারছিনা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে উঠতে। কিন্তু জেদ চেপে গেছে। আমি উঠছি। ফরহাদ ভাইয়ের জেদ চাপেনি তবুও উনি আমার পিছনে আসছেন। উপরদিকে লোক কম। অনেকেই নেমে গেছে।

একসময় ক্লান্ত হয়ে গেলাম। একজন বললো, অত উপরে না উঠলেও হবে। কাছেই জল গড়িয়ে পড়ার একটা ধারা আছে। ওখানে যেতে পারো। দুধের সাধ ঘোলে উঠবে। ভাইয়া বললেন, চল ঐ পর্যন্ত যাই। একদম উপর পর্যন্ত যাওয়া যাবে না। নিচে সবাই অনেক চিন্তা করছে মনে হয়। পানির ধারার কাছে যেতে একটু ঘুরে আমাদের ঢালের নিচে নামতে হল। নামতে যেয়ে আমি হুড়মুড় করে পড়ে গেলাম।

ফরহাদ ভাইকে খুব চিন্তিত মনে হল কিন্তু আমাকে হাত ধরে উনি তুললেন না। আমরা জলের ধারার কাছে পৌঁছে গেছি। আসলে এটি একটি  পাথুরে ছোট নদী। আমি আর ফরহাদ ভাই পাঁচ হাত দূরত্বে নদীর মধ্যে পা ডুবিয়ে বসে আছি। নদীর শীতল জল আমাদের পা ধুয়ে দিচ্ছে। ক্লান্তি ও ধুয়ে দিছে সেই সাথে। ফরহাদ ভাই হাতমুখ ধুলেন। আমিও ধুলাম। তারপর আবার পা ডুবিয়ে পাঁচ হাত দূরত্বে বসে রইলাম।

আমরা উঠলাম। মনে হয়েছিল নামাটা বেশ সোজার হবে। কিন্তু ঢালের কারণে নামতে যেয়ে শরীরে ঝাঁকুনি লাগছে। আমি বারবারই পড়ে যাবার মত হচ্ছিলাম কিন্তু নিজেকে সামলে নিচ্ছিলাম। ফরহাদ ভাই খুব দ্রুত নামছেন। নেমে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি কাছাকাছি আসতে আবার নামছেন।

অবশেষে আমরা নামলাম। রাশেদ ভাই আমাকে একটু বকুনি দিলেন। তোমাকে কখন থেকে খুঁজছি, যদি হারিয়ে যেতে। আমাকে না বলে আর কোথাও একা  যাবে না। আমি বললাম, না, ফরহাদ ভাই ছিল তো। আয়শা ভাবী একটা অশ্লীল হাসি দিয়ে বললেন, ও ফরহাদ! আমার সৌভাগ্য ফরহাদ ভাই আশেপাশে না থাকায় সেই হাসি শুনতে পেলেন না।

হাল্কা খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা আবার বেরিয়েছি। শিলা ভাবীরা বিদায় নিলেন। ওনারা এখনই সিয়াটল রওনা দিবেন। সরফরাজের গানের স্কুল আছে বিকেলে।

আমরা ভিস্তা হাউজে নেমেছি। ভিস্তা কলম্বিয়া হায়ওয়েতে। কলম্বিয়া নদী দেখার জন্য ১৯১৮ সালে এটি বানানো হয়। ভিস্তা হাউজ অনেকটা মিউজিয়ামের মত। এর  নিচে নদী, নদীর দুপাশে পাহাড়। পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলেছে নদী। আরও কিছু জায়গা ঘুরে আমরা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম। রিমি আপু অফিস থেকে ফিরেছেন। রান্না চাপিয়েছেন। রাতে চমৎকার খাওয়া দাওয়া হল। গরুর মাংস, সবজি, বেগুন ভাজা, ডিম,  ডাল। রিমি আপু ইমরান  ভাইয়াকে বললেন, ভাইয়া পোলাও করিনি। এত গরম, সবাই এত জার্নির উপর আছে। না ভাল করেছিস। পেটের অবস্থা ভাল নয় বলে ইমরান ভাইয়া চারটা ডিম খেয়ে ফেললেন। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমরা মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ টিভি সিরিয়াল দেখছি। সেখানে খুব অশালীন কিছু ডায়ালগ শোনাচ্ছে। লজ্জায় আমার কান লাল হয়ে যাচ্ছে। আমি বাকিদের দিকে তাকালাম তারা এমন ভাব করল যেন তারা এই ডায়ালগের কিছুই শোনেনি। তবে সিরিয়ালের বাকি অংশ শুনেছে। আমিও বাকিদের মত ভান করলাম।

ভোর ছ’টায় আমার ফ্লাইট। আরও অনেকেরই সকালে ফ্লাইট। রায়হান ভাই আমাদের সকালে একবারে নামিয়ে দিয়ে আসবেন। ব্যাগ গুছিয়ে রাখলাম।

ভোর চারটায় উঠলাম। আমরা রওনা দিয়েছি। রায়হান ভাই আমাদের এয়ারপোর্ট নামিয়ে দিলেন। ভাইয়াদের ফ্লাইট কিছুটা দেরিতে ছিল। আমার অলরেডি দেরি হয়ে গেছে। আমার বোর্ডিং পাস পেতে দেরি হল। দেখি ভাইয়ারা দূর থেকে আমাকে দেখেছে। মারুফ ভাই আমাকে দৌড় লাগাতে বললেন। আমি দৌড় দিয়ে সিকিউরিটি চেকে ঢুকলাম। প্লেনে উঠে মারুফ ভাইয়ের ফোন পেলাম। জানিয়ে দিলাম, প্লেনে বোর্ডিং করেছি। প্লেন ছেড়ে দিল। আবার মানুষগুলো সেই বিন্দুর মত আর শূন্য আমি।

স্যু ফলস এয়ারপোর্টে এসে দেখি হোসেন এসেছে আমাকে নিতে। আমরা নাসরিনের জন্য ওয়েট করলাম। নাসরিন আজ বাংলাদেশ থেকে ফিরছে। সেও যাবে আমাদের সাথে। তিনমাস পর নাসরিনের সাথে দেখা। জড়িয়ে ধরল ও আমাকে। দেশ থেকে নাসরিন ভীষণ মোটা হয়ে এসেছে। তাকে একটি ফুটবলের মত দেখাচ্ছে। আমরা  প্রথমে আইস্ক্রিম খেলাম। তারপর একটি রেস্টুরেন্টে গেলাম বাফেট খেতে। নাসরিন আমাদের ট্রিট দিচ্ছে। সে বিয়ে করে এসেছে, বিয়ের ট্রিট।

আমি নাসরিনের কাছ থেকে কিছু গল্প শোনার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সে কিছুতেই বললো না। বললো, এসব বললে আশরাফ আমাকে মেরে ফেলবে। খেয়ে দেয়ে আমরা রওনা দিয়েছি। প্রেইরি ল্যান্ডের রাস্তায় চলছে গাড়ি। দুপাশে চারণভূমি, মাঝাখানে রাস্তা। হোসেন গাড়ি চালাচ্ছে আর আমাদের সাথে কিছু  রসিকতা করার চেষ্টা করছে। আমরা শুধু হা হু করছি আর ক্লান্তিতে ঢলে পড়ছি। আমাদের সাথে সূর্যও ঢলে পড়ছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে।

ব্রুকিংস পৌঁছে আমরা  প্রথমে ফ্যামিলি হাউজিং এ গেলাম। রামিসারা কাল নর্থ ডাকোটা চলে যাচ্ছে। ভাবী বাসা টাসা সব পরিষ্কার করছেন। ভাবী আমাদেরকে কিছু সবজি দিলেন। এখানে বাঙালীরা সামারে নামমাত্র মুলে জমি বরাদ্দ নিয়ে চাষবাস করে। জমিগুলো একটি  চ্যারিটি সংগঠনের আন্ডারে থাকে।  তবে সেই জমি বেশি নয়। এক চিলতে  জায়গা। তবু সেটাতেই বেশ ফলন হয়। একে অন্যকে দিয়েও খেয়ে কুলিয়ে ওঠা যায় না ।

আমি রামিসা আর নুশেরার খেলনা দুটি দিয়ে আসলাম। খেলনাটি পেয়ে রামিসাকে খুব খুশি মনে হল তবে নুশেরাকে বুঝলাম না।  কারণ তার মা তাকে বন্দি করে রেখেছে। সে দুষ্টুমি করলে তার মা তাকে একটা খোলা জায়গায় দাঁড় করিয়ে বলে তুমি বন্দী। নুশেরা সেই খোলা জায়গা থেকে নড়ে না। কারণ সে তো বন্দী। বন্দী হওয়া তার কাছে খুব অপমানজনক। বন্দী হলে তার মন খারাপ থাকে।

হোসেন আমাদেরকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। আমার ধারণা বাসায় ঢুকেই নাসরিন খুব ইম্প্রেসড হবে। এত সুন্দর বাসা নিয়েছি। রুমমেট জোগাড় করেছি। ইম্প্রেসড হবারই কথা। বাসায় ঢুকেই নাসরিন বললো, ও আল্লাহ এসি কই। তুই যে বলেছিস এসি আছে। এসি দেখে নিসনি? গরমে মরে যাচ্ছি তো।

– এসি আছে। সেন্ট্রাল এসি। ছাড়লে পুরা এপার্টমেন্ট ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এসি লিভিং রুমে। দাঁড়া ইয়ামিনীকে বলছি এসি ছাড়তে। ইয়ামিনী থাকে লিভিং রুমে। ইয়ামিনী এসি ছাড়ল।

– তন্দ্রা আমার ঘর ঠাণ্ডা হয় না কেন? এই এসি তো  দেখি শুধু লিভিং রুমে কাজ করে। বাকি রুমে করে না। তন্দ্রা কি বাসা নিছিস তুই! সব দেখে নিবি না? এই গরমে কিভাবে থাকব আমি? আবার লিজও তো সাইন করে রেখেছিস এক বছরের জন্য। বুঝেছি আসলে আমি না থাকলে তুই কিছুই পারিস না।

নাসরিনের চিল্লাচিল্লিতে আমি, ইয়ামিনী কিছুটা তটস্থ। আমি বললাম, তুই বাইরে থেকে এসেছিস বলে গরম লাগছে। সবসময় বাসায়  থাকলে দেখবি  ঠাণ্ডা লাগবে। কি ইয়ামিনী ঠাণ্ডা লাগে না?

নাসরিনকে ঠাণ্ডা করতে ইয়ামিনী বললো আমার তো শীত করে, নাহারেরও করে।

সে করলে করে। আমি এভাবে থাকতে পারবনা। আমার ফ্যান লাগবে, কালকেই আমি ফ্যান কিনব।

নাসরিনের চিল্লাচিল্লি থেমে গেছে। দেশে যাবার সময় সে আমার একটা লাগেজ নিয়ে গিয়েছিল। সেই লাগেজের লক নাম্বার সে ভুলে গেছে। লাগেজ খোলা যাচ্ছে না। সে খুব অপরাধবোধে ভুগছে। আমি তাকে স্বাভাবিক করার  চেষ্টা করছি। বলছি, তুই তো একটা লাগেজের লক নাম্বার মনে রেখেছিস। আমি হলে তো দুইটাই ভুলে যেতাম। নাসরিন বললো, না তুই হলে দুইটাই ভুলতিস না। লাগেজ আনতেই ভুলে যেতিস। অনেক কষ্টে ইউটিউব ভিডিও দেখে আমরা তালা খোলার ব্যবস্থা করলাম। নাসরিন বললো, ইউটিউব রক্স। তুই দুনিয়ার যে কোনকিছুর সন্ধান ইউটিউবে পাবি। লেখাপড়া থেকে রান্নাবান্না কি নেই। আমার সব রান্না তো ইউটিউব থেকে শেখা। শাশুড়িকে অবশ্য বলিনি, চেপে গেছি। শ্বশুর বাড়িতে একদিন কি হয়েছে শোন চমচম আনা হয়েছে। সেটা ভর্তা করে আমি পাটিসাপটার পুর বানিয়েছি। শাশুড়ি তো ইম্প্রেস্ড। নাসরিন অনর্গল শ্বশুর বাড়ির গল্প করছে আর লাগেজ থেকে শাড়ির পর শাড়ি বের করছে। আমার কিছুটা মন খারাপ হল। বললো, মন খারাপ করিস না। এই শাড়ি দুটো তোর।

অরিগন থেকে ফিরে আমিও সব গুছিয়ে নিলাম। নতুন সেমিস্টার শুরু হচ্ছে। ক্যাম্পাসে যাবার সময় আমি নাসরিনের জন্য যে সাইকেল কিনেছিলাম, তা বুঝিয়ে দিলাম। ও বলল, তন্দ্রা, ও আল্লাহ্‌ তুই তো ব্যাটাদের সাইকেল কিনেছিস। এটাতে বসব কিভাবে? আর তুই যে বললি হেঁটে যেতে ১৫ মিনিট। এখন তো দেখি ৩০ মিনিট লাগে। নাসরিন বললো, শোন তোর মত হন্টন আমি করতে পারব না। মক্কায় বাসা নিয়েছিস। নভেম্বর থেকেই স্নো পড়বে। স্নোর মধ্যে এত হাঁটাও যাবে না। গাড়ি কিনতে হবে। গাড়ি চালানো শিখতে হবে আর তার জন্য এখনই গাড়ি কিনতে হবে এবং  গাড়ি চালানো শেখার অনুমতি পত্রের  পরীক্ষা দিতে হবে। যেটাকে এখানে লার্নার্স পারমিট বলে।

ম্যাপ দেখে হেঁটে হেঁটে আমি আর নাসরিন ডি এম ভি অফিসে গেলাম। ডি এম ভি হল যেখানে গাড়ি চালানো বিষয়ক পরীক্ষা নেওয়া হয়। কাগজ পত্র সব ছিল না বলে পরীক্ষার জন্য পরদিন আসতে বললো। লার্নার্স পারমিট মানে গাড়ি চালানো শেখার অনুমতি পত্র।  লার্নার্স পারমিট পরীক্ষায় রোড সিগ্ন্যাল এবং রুলসগুলো টেস্ট করা হয়। এর জ্ন্য  লিখিত পরীক্ষা নেওয়া  হয়।

লার্নার্স পারমিট পরীক্ষায় বর্তমান ঠিকানার তিনটা প্রুফ লাগে। সেটা বাসা ভাড়ার কপি, ইউটিলিটি বিল, ব্যাঙ্ক ডকুমেন্ট যে কোনকিছু হতে পারে। আর সোসাল সিকিউরিটি নাম্বার, আই ৯৪, আই ২০ লাগে। এত কাগজ পত্র পরীক্ষা করে  ড্রাইভিং লাইসেন্স অথবা পারমিট দেওয়ার কারণে আমেরিকাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স খুব গুরুত্বপূর্ণ। পাসপোর্টের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। আইডি হিসেবে  সবখানেই এটি দেখতে চায়।

পরদিন নাসরিন আমি  লার্নার্স পারমিট পরীক্ষা দিতে গিয়েছি। আমাদের সাথে এক মা ছেলেও এসেছেন। ছেলে হাফ প্যান্ট পরা মাও হাফ প্যান্ট পরা। ছেলে হাতা কাটা গেঞ্জি পরা, মাও হাতা কাটা গেঞ্জি পরা। মুগ্ধ হয়ে আমার মা-ছেলের ম্যাচিং দেখছি আর বাংলায় হাসাহাসি করছি। পরীক্ষার পর আমাদের ছবি তোলা হবে। চোখ পরীক্ষা করা হবে। পরীক্ষক হিসেবে কঠিন চেহারার দুইজন স্বাস্থ্যবান আমেরিকান বসে আছেন। দুজনেই পুলিশের ইউনিফর্ম পরা। একজন ভদ্রলোক আর একজন ভদ্রমহিলা।

নাসরিনের চোখ পরীক্ষা শেষে আমার পালা এল। আমাকে একটা ফুটোর দিকে তাকিয়ে কিছু পড়তে বলা হল। আমি খুব বেশি কিছু দেখতে পারছিলাম না। যা পারছিলাম পড়ছিলাম। আমার পড়ায় কঠিন আমেরিকান দুইজন আরও কঠিন করে তাকালেন। বার বার পড়ার পরও আমি সব পড়তে পারছিলাম না। আমার একটু একটু ভয় লাগতে শুরু করল। আমাকে পারমিট দেবে কিনা ভাবছিলাম । আমার ইদানিং কেন জানি মনে হয় চোখে কম দেখি। মাথাও তো ব্যাথা করে। তাহলে কি চোখে সত্যিই কিছু হল! আমি যখন এসব ভাবছি, হঠাৎ মহিলাটা বলে উঠল, ইওর রাইট আই ইজ নট ওয়ারকিং এট অল, ইউ শুড মিট এ ডক্টর।

আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছি। তাহলে ডান চোখে আমি সত্যিই দেখি না। বাম চোখ ভাল থাকায় এতদিন বুঝতে পারিনি। নাসরিন বললো, তোর ডান চোখ যে পুরোপুরি নষ্ট তুই জানিসই না। চমৎকার, তোর দ্বারাই এটি সম্ভব। প্রচণ্ড কান্না পেল আমার। বললাম, ক্যান আই ট্রাই ওয়ান মোর টাইম? প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা নিয়ে মহিলাটা আমাকে আরেকবার সুযোগ দিলেন।

আমি প্রচণ্ড রকম দেখার চেষ্টায় যন্ত্রটির মধ্যে একেবারে মাথা ঢুকিয়ে দিলাম। তখনি একটা আলো জ্বলে উঠলো। আর আমি সব দেখতে দেখতে পেলাম আর গড় গড় করে বলতে লাগলাম। মহিলাটি বললেন, হাউ স্ট্রেন্জ তোমার চোখ ভাল হল কি করে! চোখ ভাল হবার রহস্য হল মাথা দিয়ে আগে জোরে প্রেস করে, তারপর পড়তে হবে। এতে আলো জ্বলবে এবং লেখাগুলো দেখা যাবে। যাই হোক খুব হাসাহাসি হল সেদিন। লার্নার্স পারমিট নিয়ে আমি আর নাসরিন বাসায় আসলাম।

নাসরিন, ইয়ামিনী ওরা দুজন সাইকেলে ক্যাম্পাস যেত। আমি হেঁটে হেঁটে যেতাম। হেঁটে হেঁটে যেতে ভালই লাগতো আমার। মাঝে মাঝে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যেত। নাসরিন আমাকে বকাবকি করত ভীষণ। এত রাত করে বাড়ি ফিরছিস। যেদিন কিছু হবে সেদিন বুঝবি। আমি বললাম, কেন আমেরিকা তো খুব নিরাপদ জায়গা। এখানে তো নারীদেরকে সবচেয়ে বেশী স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতা না ছাই! তুই কি জানিস পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ আমেরিকাতে হয়। গত বছর আমাদের স্কুলের পার্কিং লটেই একটা মেয়ে রেপ হয়েছে। নাসরিনের কথা আমার বিশ্বাস হল না। আমি নেটে সার্চ দিলাম।  দেখলাম, নাসরিনের কথায় সত্যি। পৃথিবীর  সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ আমেরিকাতেই হয়। আমেরিকার ভিতরে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ হয় সাউথ ডাকোটায়। তবু আমার মনে হল, কিই বা আবার হবে। সবাই তো রাতে ফিরছে। সেদিন সব কাজ গুছিয়ে রাতে ফিরতে আমার বেশ দেরী হয়ে গেল। রাস্তা পার হবার জন্য একটা  সিগন্যালে দাঁড়িয়েছি। চার-পাঁচটি ছেলে সহ একটা গাড়ি দাঁড়ালো আমার পাশে।

-ডু ইউ ওয়ান্না গো উইদ আস, এভ্রিবডি ওয়ান্টস এ কিস?

প্রচণ্ড ভয়ে কিস না দিয়েই আমি জোরে হাঁটা দিলাম। তবে এই ঘটনা শুনে ভয়ের কারণ নেই। এখানে মেয়েরা একা একা মধ্য রাতেও চলাফেরা করে। তবে গাড়িতে। গাড়িতে থাকলে ভয় নেই। তবে হেঁটে চলাফেরা করলে কিছুটা সাবধানে হওয়াই ভাল। কারণ বিপদের ঘণ্টাটা ঠিক কখন বাজবে, কেউই জানে না।

শীত আসছিল। গাছের পাতা ঝরা শুরু করেছে। প্রচুর পাতা ঝরছে। তবে পাতা কুড়োনী বা ঝাড়ুদারনী কোথাও দেখছিনা। পরিষ্কার রাস্তায় হাঁটছি। একদিন আমি পাতা কুড়োনীকে দেখলাম। দেখেই বুঝলাম আমেরিকানরা কি অসম্ভব কুড়ে জাতি। পাতা কুড়োনী হল একটি গাড়ি। গাড়িটি থেকে অনেক জোরে বাতাস দেওয়া হচ্ছে। সেই বাতাসে সব পাতা এক জায়গায় জমা হচ্ছে। তারপর অনেকটা ভ্যাকুয়াম করার মত কালেক্ট করা হচ্ছে। যান্ত্রিক এই পাতা কুড়োনীকে দেখে আমি খুব মুগ্ধ। রাস্তাঘাট তাহলে এই ভাবে ঝাড়ু দেওয়া হয়! কিন্তু তাহলে বাসার ডাস্টবিনের ময়লাগুলো কিভাবে সংগ্রহ করে? দেখি এখানেও আমেরিকানরা অসীম কুড়েমির আশ্রয় নিয়েছে। একটা গাড়ি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। ক্রেন দিয়ে ডাস্টবিন তুলে ময়লা ফেলছে। আবার ডাস্টবিন যথা স্থানে ক্রেনের সাহায্যে রেখে দিচ্ছে। এজন্য ড্রাইভারকে নামতে হচ্ছে না। কোন মানুষের সাহায্যই লাগছে না। আমেরিকার এই কুড়েমি দেখে আমি অভিভুত। আমার শুধু মনে হচ্ছে আমাদের দেশে কি এরকম কিছু করা যায় না। করলে ভীষণ ভাল হয়। বাংলাদেশে ময়লা সংগ্রহের জন্য যে ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেদের ব্যবহার করা হয়, অনেক রোগ জীবাণু স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে তাদের বাঁচানো যায়।

নাসরিন বললো, শোন গাড়ি কেনার জন্য আমি ক্রেইগ লিস্টে চোখ রাখছি। তুইও রাখ। অবশ্য তোকে বলাই ভুল। জীবনেও রাখবিনা জানি। জীবনেও রাখবনা জেনেও আমি বললাম, রাখব। নাসরিন প্রতিদিন আমাকে এখন বিভিন্ন গাড়ির গল্প শোনায়। এই গাড়ি, সেই গাড়ি সে দেখেছে। এখন আমার মতামত চায়। মনে মনে বলি আরে একটা কিনলেই তো হয়। কিন্তু সেটি বলে নাসরিনের মাথা গরম করার মানে হয় না। তাই বললাম, তোর পছন্দই আমার পছন্দ। আমার কথায় নাসরিন ভীষণ খুশি। নাসরিন একটি গাড়ি দেখেছে সেটি দেখতে আমরা হোসেনকে নিয়ে স্যু ফলস রওনা দিলাম।

বিভিন্ন ঝামেলার পর অবশেষে গাড়িটি কেনা হল। রেজিস্ট্রেশন, টাইটেল চেঞ্জ সব ঝামেলা নাসরিনই সামলালো। এখন শেখার পালা। কোন বাঙালিই আমাদের গাড়ি চালানো শেখাতে রাজী হল না। সময় নেই বলে এড়িয়ে গেল। আগে হেরল্ড নামে এক আমেরিকান বুড়ো শেখাতো। এখন সেও শেখানো বন্ধ করে দিয়েছে। সস্তার আর কোন ড্রাইভিং স্কুলও আমাদের জানা নেই। ভীষণ চিন্তায় পড়লাম আমরা। গাড়ি কেনা হয়েছে অথচ কেউই চালাতে জানি না। নাসরিন বললো, চিন্তা করিস না। হোসেন আছে না, বালাজি আছে। ওদের সাথে মিষ্টি করে কথা বলতে হবে। তোর ল্যাবের ছেলেগুলোর সাথেও বলতে হবে। মিষ্টি কথায় কাজ হয়নি এরকম কথা শুনেছিস কখনও। তবে মিষ্টি কথা আমার থেকে বেশি তোকে বলতে হবে। আমি বললে খারাপ দেখাবে। ওরা ভাবতে পারে, আমি দেশে স্বামী রেখে ওদের সাথে পরকীয়ার চেষ্টা করছি। আর তুই তো আগে থেকেই ন্যাকা আছিস। ন্যাকামির পরিমাণ আর একটু বাড়িয়ে দিলে ছেলেরা বাড়ি এসে ড্রাইভিং শেখাবে।

আমরা ন্যাকামি করেছিলাম কিনা জানি না। যতদূর জানি স্বাভাবিক ভাবেই বলেছিলাম। তাতেই ছেলেরা বাড়ি এসে আমাদের ড্রাইভিং শেখাতে লাগলো। তবে ওদের আচার আচরণ দেখে কখনই মনে হয়নি ওরা ভিন্ন কোন কারণে আমাদের শিখিয়েছে। স্রেফ বন্ধুত্ব ও বন্ধুর প্রতি সহযোগী মনোভোব থেকেই করেছে। আমাদের ইন্সট্রাক্টর ছিল অনেকজন। ব্যস্ততার কারণে সবাই এক দুই দিন করে, কেউ একটু বেশী সময় দিয়েছে। আমরা গাড়ি চালানো শেখার জন্য ফাকা পার্কিং লট খুঁজছিলাম। প্রথমদিন হোসেন আমাদেরকে পাঁচটার পর নিয়ে গেল। নাসরিন বাংলাদেশ থেকেই ড্রাইভিং জানতো। ও কিছুক্ষণ চালাল। এবার আমার পালা। আমি ভালই চালালাম। শুধু গাড়ি সোজা রাখতে পারছিলাম না। টার্নিং এর সময়ও  সঠিক লেনে  থাকতে পারছিলাম না। হোসেন বললো, চিন্তা কর না, নাহার আস্তে আস্তে হবে। আর তখনই একটি গাছের সাথে বাড়ি খেতে খেতে আমি বেঁচে গেলাম। ব্রেকে পা চাপতে যেয়ে এক্সিলারেসনে পা দিয়ে ফেলেছি।

নাসরিন চিৎকার দিয়ে উঠলো, এই ছেমড়ি সবখানে গণ্ডগোল পাকায়।

 

 


প্রবাসে সিরিজের গল্পসমূহঃ

 পর্ব ১ঃ যাত্রাপথের গল্প
 পর্ব ২ঃ নতুন বাসা, ওরিয়েন্টেশন, রাস্তা হারানো
 পর্ব ৩ঃ পুলিশ আসা, রেজিস্ট্রেশন বিড়ম্বনা
 পর্ব ৪ঃ ডরমেটরির গল্প, প্রথম তুষারপাত
 পর্ব ৫ঃ ইন্টারন্যাশনাল নাইট, বাসা নিয়ে ঝামেলা, শায়লা আপুর চলে যাওয়া
 পর্ব ৬ঃ কামরানকে হাসপাতালে নেওয়া, টেকো সুদীপ আর ব্রিটিশ প্রফেসরের গল্প
 পর্ব ৭ঃ ল্যাব ও ফরাসী যুবকের হৃদয় ভাঙার গল্প।
 পর্ব ৮ঃ সামার এসেছে, বেতন পাইনি, প্রথম বাসা ছেড়ে দিলাম
 পর্ব ৯ঃ সঙ্গীহীন জীবন, সুরিয়া মথুর গল্প, সামারের দিনলিপি, একা পথ চলা
 পর্ব ১০ঃ বিদেশী ভাষা শেখা ও আমেরিকান চাষাবাদের গল্প
 পর্ব ১১ঃ আমার বাইবেল শেখা
 পর্ব ১২ঃ সাজ্জাদের চলে যাওয়া, লিবিয়ান পরিবারের গল্প
 পর্ব ১৩ঃ মুহিত ভাইয়ের গল্প, আমার আগুন ধরিয়ে ফেলা
 পর্ব ১৪ঃ মসজিদ, ঈদ, ইয়ামিনী আসা, নতুন বাসা, আমেরিকান বিয়ে ও অরিগন যাবার গল্প
 পর্ব ১৫ঃ অরিগন ভ্রমন, শুরুর গল্প।
 পর্ব ১৬ঃ অরিগনের গল্প, ক্যানন বিচ, লাল টমেটো
 পর্ব ১৭ঃ
 পর্ব ১৮ঃ
 পর্ব ১৯ঃ

লেখক পরিচিতিঃ

 জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ ক্যারোলিনা এ এন্ড টি স্টেট’ ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ‘PhD’ করছেন এবং তার গবেষণার বিষয় হল ‘Real time Object detection with Higher Accuracy’। jannatunজান্নাতুন নাহার তন্দ্রার স্কুল জীবন কেটেছে চুয়াডাঙ্গা শহরে, কলেজ জীবন হলিক্রস কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। এবং সেখান থেকেই ২০১০ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষে ২০১২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং ২০১৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা অবসরে লিখতে ভালবাসেন এবং সে অভ্যাস বশতই আমেরিকার গ্রাজুয়েট প্রোগামে একা একটি মেয়ে পড়তে আসার অভিজ্ঞতা (সাউথ ডাকোটা) একসময় তিনি লিখতে শুরু করেন। এবং তার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘প্রবাসে’ নামে ২০১৫ সালের ‘একুশে বই মেলায়’ তার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি কোন তথ্যমূলক বই নয় বরং বলা যায় এটি লেখিকার রোজকার ডায়েরী।