গ্রাড কো–অর্নিডেটর আমাকে ডাকলেন। সেমিনার কোর্স ইন্সট্রাকটর ডক্টর ডেনিশ হেলডার এর কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন, আমার দেখা অসম্ভব ভাল মানুষদের একজন। আমাকে ওয়েলকাম করলেন উনি। আমি তখন ভয়ে কাঁপছি। তিনি এমন ভাব করলেন, যেন কিছুই হয়নি। আমাকে ঘুরে ঘুরে তার ইমেজ প্রসেসিং ল্যাব দেখালেন। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, তুমি এক মাস পিছিয়ে গেছো, তবে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা অনেকেই প্রথমে ভুল করে। তুমি ভীষণ হার্ড ওয়ার্ক করলে, এই পিছিয়ে যাওয়া সমস্যা দূর হয়ে যাবে। তার জন্য এতদিনে যত পেপারের উপর সেমিনার হয়েছে, সেগুলার সামারি আমাকে দু’ সপ্তাহের মধ্যে লিখে দিতে হবে। এরপর তিনি আমাকে যশ নামে এক ব্যক্তির কাছে নিয়ে গেলেন। যশ আমাকে কিছু পেপার দিল। পরের দিন তিনি আমাকে আবার ডাকলেন, বললেন আমি রশকে বলে দিচ্ছি, ও তোমাকে আরও কিছু পেপার দিবে।

আমি ল্যাবে গেলাম। রশকে দেখলাম। রশ আর যশ দেখতে হুবহু একরকম। নামেও বেশ মিল। তাই ধরে নিলাম ওরা যমজ ভাই। আমেরিকানদের মিলিয়ে নাম রাখার ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগল। একবার ভাবলাম বলি, তুমি দেখতে একদম তোমার ভাইয়ের মত। এরকম আইডেন্টিকাল টুইন আমি আগে দেখিনি। পরে মনে হল, থাক। আমেরিকানরা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলোচনা পছন্দ করে না।

কয়েকদিন পার হয়ে গেছে, সামারি লেখার ফরম্যাট জানতে আমি ল্যাবের এক নেপালি ইমপ্লয়ির কাছে গেছি। ও আমাকে বললো, এ পেপার তুমি কোথায় পেলে? তোমার কি ডাউনলোড করার এক্সেস আছে?

-বললাম, কেন রশ !

 সে আবার কে?

-কেন যশ এর ভাই।

অনেকক্ষণ সে হাসল আর আমি বুঝলাম, রশ আর যশ একই ব্যক্তি, রশ বলে কেউ নেই। একসেন্ট জটিলতায় আমি সেটি ধরতে পারিনি। যশ ছিল জার্মান আমেরিকান। তার কাজ ছিল মনোযোগ দিয়ে অফিস করা আর প্রতি বৃহস্পতিবার ড্রিঙ্ক করে মাতাল হওয়া। প্রতি বৃহস্পতিবার সেমিনার ক্লাস থাকত। ঐ দিন মিটিং এ সে একটা টি শার্ট পরে আসত। তাতে লেখা থার্স্টি থার্সডে। অর্থটা এরকম, আজ বৃহস্পতিবার এবং আমি পিপাসার্ত।

আমেরিকানরা সপ্তাহের পাঁচদিন পরিশ্রম করে। আর ছুটির দুইদিন ফুর্তি করে। ফুর্তির শুরুটা হয় শুক্রবার সন্ধ্যায় মাতাল হওয়া দিয়ে। মাতাল হওয়ার জন্য যশ কেন বৃহস্পতিবার বেছে নিয়েছিল সেটা তাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। সেমিনারে আমি হাঁ করে সবার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, কিছুই বুঝতাম না। আমেরিকাতে আমার প্রথম সেমিস্টার কাটল হাঁ করে। হাঁ করে তাকিয়ে লিপ রিডিং করতাম। তা না হলে কথা বার্তা বোঝা যেত না।

দুসপ্তাহ পার হয়েছে। আমি সামারি জমা দিয়েছি। অনেকটা হালকা লাগছে। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের নিয়ে একটা ওরিয়েন্টেসন প্রোগ্রাম হবে হিলক্রেস্ট পার্কে। বাসা থেকে পনের মিনিটের পথ। আমি, নাসরিন আর শায়লা আপু; আমরা হেঁটে রওনা দিয়েছি। পথে রাস্তা পার হতে হবে। আমরা রাস্তা পার হবার চেষ্টা করছি কিন্তু পার হতে পারছিনা। সিগন্যাল পড়ছেনা, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। একটা ইরানি ছেলে সাইকেল নিয়ে আসে আমাদের পাশে। রাস্তার পাশে রাখা একটি বোতামে চাপ দেয়। সিগন্যাল পড়ে, রাস্তা পার হই। ছেলেটিই বলে, এই বাটনটা পথচারীদের রাস্তা পার হবার জন্য। যখন দরকার বোতামে চাপ দিবে, লাল সিগন্যাল বদলে পথচারীদের হাঁটার সাইন দেখা যাবে। ছেলেটি আমাদের সাথে গল্প করতে করতে পার্ক পর্যন্ত যায়। ওকে আগেও দেখেছি। দেখলেই হাসে। হাবে ভাবে মনে হয়েছে কথা বলতে চায়। যেতে যেতে সে আমাদের পরিচয় নেয়। ছেলেটি মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের। ইরানে আট বছর চাকরি করে এখানে পড়তে এসেছে। আগে মিলিটারিতে ছিল। ইরানে গ্রাজুয়েশনের পর ছেলেদের মিলিটারিতে যাওয়া বাধ্যতামূলক। তবে কয়েক বছর পর ওরা আবার নিজের পছন্দের পেশা বেছে নিতে পারে।

ওরিয়েন্টেসন এ প্রচুর খাওয়া দাওয়া ছিল। যদিও আমি চিকেন ছাড়া আর কিছু খেতে পারলাম না। প্রোগ্রাম শেষে আমরা বাসায় ফিরছি। দেখি হোসেন আমাদের পাশে পাশে আসছে। আমরা কথা বলতে বলতে বাসার কাছে পৌঁছে গেছি। সৌজন্যতাবশত তাকে ভিতরে আসতে বললাম, সাথে সাথে সে রাজি হয়ে গেল।

আমি শায়লা আপু আর হোসেন ডাইনিং এ বসে গল্প করছি। নাসরিন নাস্তা রেডি করছে। আমরা হোসেনকে কাবাব, চা, নুডুলস দেই, সে সব খেয়ে ফেলে। খেয়ে দেয়ে প্রচুর গল্প করে। একসময় আমরা খুব বিরক্ত হয়ে যাই। তবুও হাসি হাসি মুখ করে থাকি। আমরা কালচার আর ইতিহাস নিয়ে কথা বলি। একসময় ধর্ম আসে। ইসলাম ধর্ম নিয়ে হোসেন বেশ খারাপ কথা বলে। একজন ইরানি মুসলিমের কাছে এধরনের কথা আমাদের কাছে অদ্ভুত শোনায়। শায়লা আপু খুব রেগে যায়। তবে হোসেনকে আমার ভাল মানুষই মনে হয়। এক সময় নাসরিন আর হোসেন একি ডিপার্টমেন্টে পড়ার কারণে ভাল বন্ধু হয়ে যায়। নাসরিন বলে, ইরানিরা এরকমই, খেয়াল করেছিস, এখানে যতগুলো ইরানি মেয়ে আছে, অধিকাংশই খুব ছোটো জামা পরে, হাফ প্যান্ট পরে ফেসবুকে ছবি দেয়। আমি ইরানি মেয়েদের খেয়াল করা শুরু করি।

সেমিস্টার মোটামুটি মাঝ পথে, আমরা লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকি। মাঝে মাঝে সাজ্জাদের সাথে বের হই। সাজ্জাদ আমাদেরকে বাজারে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ওর সাথে গাড়িতে কামরান আর আশিক থাকে। ওরা দুজনও আমাদের ব্যাচের। আশিক ছেলেটা একটু দুষ্টু। আমাকে দেখলেই ঠাট্টা তামাশা করে। ওর পারফরমেন্সে সবাই মজা পাই। আমার বেশ মন খারাপ হয়। তবে ওকে কিছু বলি না।

নাসরিনকে নিয়ে ওরা কিছু বলে না। নাসরিনকে বেশ ভয় পায়। তবে নাসরিনের সাথে ওদের খুব ভাব হয়। নাসরিন যেখানেই যায় ভাব জমিয়ে ফেলে। পুরা ভার্সিটির অর্ধেক ছেলেমেয়ে ওর বন্ধু হয়ে যায়। আমার আর শায়লা আপুর বন্ধু হয় না। উইকেন্ডে বিকেলে বের হই আমরা। হাঁটা হাঁটি করি। অনেক আমেরিকানদের দেখি হাঁটতে। দেখা হলেই ওরা হাসে, হাই বলে। অচেনা লোককে হাই বলার ব্যাপারটা প্রথম প্রথম খুব অদ্ভুত লাগত। তবে এখন আমরাও হাই দেই। প্রতিদিন হাঁটতে হাঁটতে আমরা নতুন নতুন রাস্তা খুঁজি। হাঁটতে হাঁটতে আমেরিকানদের ঘরবাড়ি দেখি। হাঁটা চলা দেখি, জামা কাপড় দেখি আর সেগুলো নিয়ে বাংলায় নিজেরা আলোচনা করি। অনেক গাছ, লতাপাতা চোখে পড়ে। প্রতিটা বাসার সামনে লন। লন ভর্তি ঘাস। ঘাসগুলো ভীষণ সবুজ, পরিপাটি করে ছাঁটা। গাছগুলোর পাতায় একটুও ধুলো জমে নেই। রাস্তার কোথাও একটুও ময়লা নেই। আমি মুগ্ধ হই আর প্রতিদিন গল্প সাজাতে থাকি ক্যাডেট কলেজ থেকে, ভাই ফিরলে কি কি বলা যাবে। আমি অবাক হয়ে ভাবি, কিভাবে সব কিছু এত সাজানো গোছানো হতে পারে! আমেরিকা আমার কাছে রূপকথার শহর মনে হয়। আমি আবার আমেরিকার প্রেমে পড়ে যাই।

হাঁটাহাঁটি শেষে আমি আর শায়লা আপু বাসায় ফিরি। তখনও সূর্য ডোবেনি। এত লম্বা বিকেলে ক্লান্ত হয়ে যায় আমরা। ইউটিউব থেকে নাসরিন একটি নতুন ডিস রান্না করেছে। সেটা খেয়ে ক্লান্তি দূর করি। আমি আর নাসরিন অনেক গল্প করি। নাসরিন ওর জীবনের সব গল্প বলে। দাঁড়ি, কমা সহ সব বলে। অনেক গল্প কয়েকবার করে বলে। প্রতিটা গল্পের শুরুতে বলে, সে এক ইন্টারেস্টিং কাহিনী। ইন্টারেস্টিং কাহিনী শুনতে শুনতে একসময় আমি ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলি। তবুও উঠি না। শায়লা আপু আসে, তার গল্প বলে সেগুলোও শুনি। মন খারাপ হয় আমার। খুব দেশের কথা মনে পড়ে তখন। আমি রুমে চলে আসি। আমি এখন লিভিং রুমে থাকি। আমার জানালার পাশে একটা রেস্টুরেন্ট। জানালা দিয়ে মানুষ দেখি। খাবার জন্য তাদের আয়োজন দেখি। কাল চুলের, তামাটে চামড়ার কাউকে দেখলে আমার খুব ভাল লাগে। খুব আপন মনে হয়। তবে সেরকম কাউকে দেখা যায় না।

একদিন রায়হান ভাইয়ের বউ পিয়া আসে আমাদের বাসায়। আমাদেরকে একটি জায়গায় নিয়ে যায়। বেলা নামে ব্রাজিলিয়ান একটি মেয়ে আমাদেরকে রাইড দেয়। বেলাকে অসম্ভব সুন্দরী না বললে অবশ্যই কম বলা হবে। গল্পে গল্পে বুঝি  অনেক ছেলেই বেলার পিছনে ঘুরছে। কিন্তু কোন লাভ নেই। বেলার আমেরিকান একটি ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামারের ছুটিতেই তারা বিয়ে করছে। আমেরিকাতে অনেক ইন্টারন্যাশনাল ছেলেমেয়েদের মধ্যে অদ্ভুত একটি বিষয় দেখা যায়। এরা আসার কয়েকমাসের মধ্যেই বিপরীত লিঙ্গের আমেরিকান বন্ধু জুটিয়ে ফেলে। যেন লেখাপড়া মূল উদ্দেশ্য নয়, আমেরিকান সঙ্গী জোটাতেই এরা আমেরিকা এসেছে।

জায়গাটি হল স্টুডেন্ট ডরমেটরি বা হল যেকোনোটি বলা যেতে পারে। হলের গল্প তৃপ্তি আপুর কাছে আগেই শোনা। তৃপ্তি আপু আমাদের সাথেই পি এইচ ডিতে ভর্তি হয়েছেন। উনি হলে থাকেন। আপুই বলেছিল, এখানকার হলগুলোতে ছেলেমেয়েরা এক সাথে থাকে। কিন্তু এক রুমে নয়। তবে যে কেউ চাইলেই অন্যের রুমে যেতে পারে। রাতও কাটিয়ে আসতে পারে। কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।  রাত কাটিয়ে কেউ যেন ঝামেলায় না পড়ে সে ব্যবস্থাও আছে। রাত কাটানো ছেলেমেয়েদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফ্রি জন্মনিরোধক দেওয়া হয়। অবিবাহিত ছেলেমেয়েরা স্টুডেন্ট হেলথ সেন্টারে গিয়ে অবলীলায় বলে, আমি এখন একজন এর সাথে ঘুমাচ্ছি। ঘুমাতে যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেই জিনিস দাও। কেউ কেউ গিয়ে বলে দেখ, আমি ঘুমিয়ে মা হয়ে যাচ্ছি, আমাকে এবরশন করিয়ে দাও কিন্তু হেলথ সেন্টার গুলো সেটি করতে চায় না।

শুনেছি এবরশনকে আমেরিকাতে খুব জঘন্য অপরাধ ধরা হয়, কেউ করলে শাস্তি পেতে হয়। কাকুতি মিনতিতেও কাজ হয় না। প্রাণের মত এত দামী জিনিস হত্যার বিধান আমেরিকান আইনে নেই। এ আইনে অসংখ্য কচি প্রাণ বেঁচে যায়, পৃথিবীর আলো হাওয়ায় ভাগ বসায়। অবিবাহিতরা গর্ভবতী হলে তাদেরকে সেবা দেওয়া হয়। বাচ্চা প্রসবের ব্যবস্থা করা হয়। বাচ্চার বাবা কে এই নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কারণ দশ মাসের গর্ভধারিণীকে অসম্মান জানিয়ে, দায়িত্ব জ্ঞানহীন একটা লোককে নিয়ে খোঁজ খবর করা আমেরিকানদের কাছে অযৌক্তিক।

হলে কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হয়। আমাদের এক্সেস ছিল না। বেলা তার কার্ড পাঞ্চ করে আমাদের ঢোকায়। ভিতরে ঢুকে দেখি অনেক বড় ওপেনিং স্পেস। সেখানে বসে কেউ টিভি দেখছে, কেউ পড়ছে। আমরা লিফটে পাঁচতলায় আসি। অনেক সারিবদ্ধ দরজা। অনেকটা আবাসিক হোটেলের মত। করিডোরগুলোতে ছেলেমেয়েরা হাঁটছে। একটি দরজায় নক করলাম আমরা। দেখি এর মুখোমুখি আর একটি দরজায় যে এপার্টমেন্টটি, সেখানে হোসেন আর একজন বাঙালী ভাইয়ায় নাম লেখা। এখানে বাঙালীরা আন্ডারগ্রেড ছাড়া কেঊ ডরমেটরিতে থাকে না। ডরমেটরিতে অনেক খরচ পড়ে। তবে আন্ডারগ্রেডদের জন্য থাকাটা বাধ্যতামূলক। বাঙালী ভাইয়ার গল্প একটু সংক্ষেপে বলা যেতে পারে। উনি বাঙালীদের আড্ডায় আসেন, তবে মেয়েদের সাথে কখনও কথা বলেন না। সবার ধারনা প্রেমে ব্যর্থতায় ওনার নারী অনাগ্রহের মূল কারণ। উনি আমেরিকাতে প্রথমে এসে একটি সাইকেল কেনেন। সাইকেল কেনার পর সাইকেলের চেয়েও বেশী দামে ইনস্যুরেন্স কেনেন। তবে এখন ওনার গাড়ী আছে। উনি খুব ভালো গাড়ী চালান। তবে পুলিশ দেখলে চোখ বন্ধ করে ফেলেন আর স্পিড আকাশে তোলেন যাতে পুলিশ তাকে কোনভাবেই না ছুঁতে পারে। এ কারণে ভয়ে কেঊ তার গাড়িতে উঠতে চায়না। উনি মাসে একটি লিস্টি করে বাজার করেন, তবে কোন খাবার যদি আগেই ফুরিয়ে যায়, বাকি মাস না খেয়ে থাকেন। ওনার ফান্ডিং খুব ভাল, খাবারটি খুব হয়ত প্রয়োজনীয় আর সস্তা, তবুও উনি কেনেন না।

দরজায় নক করলে একটি আমেরিকান মেয়ে খুলে দিল আমাদের। বেশ বড় গোছালো ড্রয়িংরুম। অনেকগুলো সোফা। সেখানে অনেক মেয়ে বসা। সাথেই পরিচ্ছন্ন কিচেন ডাইনিং। আর এক পাশে কটি বেডরুম। দেখে মনে হলো, হল নয় কোন বড়লোক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। মেয়েটিই আমাদেরকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। মেয়েটি সিভিল ইন্জিনিয়ারিং এ পড়ে। সেই এ ক্যাম্পেইনটির পরিচালক। ক্যাম্পেইনটির উদ্দেশ্য একটি ব্র্যান্ডের কসমেটিক্সের সম্প্রচার। তবে এই নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমাদের কাজ হল ইচ্ছামত মেকআপ করা ও তারপর ছবি তোলা। মেকআপ ওরাই দিবে, তবে মেকআপ নিজেকে করতে হবে। ছবি তোলা হবে মেকআপ করার আগে ও পরে। যাতে পার্থক্য থেকে মেকআপের অসাধারণ গুনাগুন বোঝা যায়। তারপর সেখান থেকে সবচেয়ে সেরা পাঁচটি পার্থক্য ওরা বাছাই করবে। রাস্তার বিলবোর্ডে সেটি প্রকাশ করা হবে।

আমরা মেকআপ শুরু করলাম। ফ্রি মেকআপ তাই ইচ্ছামত মাখলাম। যেখানে দরকার নেই, সেখানেও ঘষলাম। তবে নাসরিন পরিমাণ মত ঘষল। ওকে ভালও লাগছিল দেখতে। মেকআপ করে চেহারা অনেকটায় বদলে ফেলেছে নাসরিন। মালয়েশিয়ার একটি মেয়ে তার রীতিমত পাকা হাত বলতে হয়। মেকআপের পর মেয়েটিকে চিনতে আমার খুব কষ্ট হয়ে গেল। বাছাই পর্বে নাসরিনের নাম বলা হল। কিন্তু সে তার ছবিটি বিলবোর্ডে ছাপাতে চাইলনা। এরকম সুবর্ণ সুযোগ হেলাফেলা করায় বাকিরা খুব অবাক হল।

ক্যাম্পেইন শেষে আমরা বাসায় আসলাম। মেকআপ তুললাম। মেকআপ তুলতে খুব বেশি ঘষাঘষি করতে হল না। আসার সময় একটি করে ফ্রি মেকআপ রিমুভার ওরা দিয়ে দিয়েছে সাথে। মেকআপ তোলার পর আমরা আবার আগের চেহারায় ফিরে গেলাম। নাসরিন অবশ্য এর আগেই কয়টি সেলফি তুলে নিয়েছে। ফেসবুকে পোস্টও দিয়েছে।

বেশ কয়েকদিন পার হল।

সাজ্জাদ আর মনির ভাই এসেছে বাসায়। মনির ভাই আমাদের ক্যাম্পাসের। এখানে উনি আমাদের দেখাশোনা করেন। নানা সমস্যায় বিভিন্ন পরামর্শ দেন। ভুল টুল করলে ঝাড়ি দেন। অনেক সময় ওনার ব্যবহার খুব কষ্টদায়ক মনে হয়। তবে মাঝে মাঝেই উনি আমাদের ডেকে পাঠান। তখন সাজ্জাদ আমাদের নিতে আসে, বাসায় আজ রুই মাছ রান্না হয়েছে। চল, রেডি হও, আমি পার্কিং লটে, এক মিনিটে আসবা। কোন সাজ গোজের দরকার নেই। আমরা বাসার জামা গায়ে দিয়েই রুই মাছ খেতে যাই। দেখি নাসির ভাই আর তার পরিবারও এসেছেন। কামরান, আশিক আর আরও দুজন ভাইয়াও এসেছেন। নাসির ভাই আমাদের থেকে ষোলো বছরের বড়। তবে আসর মাতাতে তার ও তার স্ত্রীর জুড়ি নেই। নাসির ভাইয়ের স্ত্রীর কয়েকদিন আগে বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চাটিও এসেছে। ওনার বড় ছেলেটি সেভেনে পড়ে। ওকে দেখলে আমার ছোট ভাইয়ের কথা মনে হয়। সাজ্জাদ বললো, রফিক স্যার সবাইকে ওনার বাসায় ঈদের দাওয়াত দিয়েছেন। রফিক স্যার এখানকার একজন ফ্যাকাল্টি।

পরশু কুরবানি ঈদ। নাসরিন বিশাল লিস্ট করে, কি কি ঈদে রান্না হবে, কাকে কাকে দাওয়াত করা হবে। ঈদ পালন করা হবে না, সে কিছুতেই মানতে পারে না। সাজ্জাদ বলে, দাওয়াত করলে হালাল গরু কিন, এখানে অনেকে হালাল ছাড়া খায় না । হালাল মাংসের দাম হালাল ছাড়া থেকে অনেক বেশি। আমেরিকাতে হালাল বলতে আল্লাহ্‌র নামে জবাই করা মাংস বোঝানো হয়। আমি আর নাসরিন হালাল মাংস কিনতে সাজ্জাদের সাথে বের হই। শায়লা আপু যায়না আমাদের সাথে। শায়লা আপু ইদানিং কোথাও যায়না। ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। পাকিস্তানিটার সাথে ঝামেলা হয়েছে কিনা জানিনা। ছেলেটি আপুকে জানিয়েছে, আপুকে তার ভাল লাগে।

আমরা অনেক কেনাকাটা করি। আমাদের ঈদের রান্না শুরু হয়। নাসরিন রাঁধুনি, আমি সহকারী। আমি সহযোগিতায় অনেক ভুল করি। অনেক রান্নায় গুবলেট পেকে যায়। বিভিন্ন সস দিয়ে নাসরিন গুবলেট ঠিক করে। তারপর আমাকে বলে যেকোনো রান্নায় তুই সস দিবি, একদম অরিজিনাল স্বাদ ফিরে পাবি। সস এমন জিনিষ রান্না মজা হবেই।

বিকেলে সাজ্জাদ বলেছিল আজকে রাত ১১টার পর স্নো ফল এলার্ট আছে। ১১টা বেজে গেছে। আমি আর নাসরিন দাঁড়িয়ে আছি বাসার সামনে। শায়লা আপুও এসেছে। আপুর মন ভাল হয়ে গেছে। নাসরিন আর শায়লা আপু খুব ছোটাছুটি করছে। এ ওর গায়ে বরফ ছুঁড়ে মারছে। আমি স্থির হয়ে গেছি। আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কিছু আমি দেখছি। আকাশ থেকে তুলোর মত সাদা সাদা বরফ নেমে আসছে। সাদা মখমলে ঢেকে যাচ্ছে রাস্তাঘাট বাড়ির ছাদ। ভীষণ শুভ্র হয়ে উঠছে সব। আমার ভীষণ মন খারাপ হল। এত সুন্দর কিছু ছোট দুই ভাই বোনকে না দেখাতে পারায় মন খারাপ হল।

ঈদের সকাল। আমি অনেকগুলো সোয়েটার আর ব্লাঙ্কেট জড়িয়েছি। হাত–পা সব জমে আসছে। আমাদের হিটার নষ্ট হয়ে গেছে। তাপমাত্রা মাইনাস পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

 


প্রবাসে সিরিজের গল্পসমূহঃ

 পর্ব ১ঃ যাত্রাপথের গল্প
 পর্ব ২ঃ নতুন বাসা, ওরিয়েন্টেশন, রাস্তা হারানো
 পর্ব ৩ঃ পুলিশ আসা, রেজিস্ট্রেশন বিড়ম্বনা
 পর্ব ৪ঃ ডরমেটরির গল্প, প্রথম তুষারপাত
 পর্ব ৫ঃ ইন্টারন্যাশনাল নাইট, বাসা নিয়ে ঝামেলা, শায়লা আপুর চলে যাওয়া
 পর্ব ৬ঃ কামরানকে হাসপাতালে নেওয়া, টেকো সুদীপ আর ব্রিটিশ প্রফেসরের গল্প
 পর্ব ৭ঃ ল্যাব ও ফরাসী যুবকের হৃদয় ভাঙার গল্প
 পর্ব ৮ঃ সামার এসেছে, বেতন পাইনি, প্রথম বাসা ছেড়ে দিলাম
 পর্ব ৯ঃ সঙ্গীহীন জীবন, সুরিয়া মথুর গল্প, সামারের দিনলিপি, একা পথ চলা
 পর্ব ১০ঃ বিদেশী ভাষা শেখা ও আমেরিকান চাষাবাদের গল্প
 পর্ব ১১ঃ আমার বাইবেল শেখা
 পর্ব ১২ঃ সাজ্জাদের চলে যাওয়া, লিবিয়ান পরিবারের গল্প
 পর্ব ১৩ঃ মুহিত ভাইয়ের গল্প, আমার আগুন ধরিয়ে ফেলা
 পর্ব ১৪ঃ মসজিদ, ঈদ, ইয়ামিনী আসা, নতুন বাসা, আমেরিকান বিয়ে ও অরিগন যাবার গল্প
 পর্ব ১৫ঃ
 পর্ব ১৬ঃ
 পর্ব ১৭ঃ
 পর্ব ১৮ঃ
 পর্ব ১৯ঃ

লেখক পরিচিতিঃ

 জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ ক্যারোলিনা এ এন্ড টি স্টেট’ ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ‘PhD’ করছেন এবং তার গবেষণার বিষয় হল ‘Real time Object detection with Higher Accuracy’। jannatunজান্নাতুন নাহার তন্দ্রার স্কুল জীবন কেটেছে চুয়াডাঙ্গা শহরে, কলেজ জীবন হলিক্রস কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। এবং সেখান থেকেই ২০১০ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষে ২০১২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং ২০১৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা অবসরে লিখতে ভালবাসেন এবং সে অভ্যাস বশতই আমেরিকার গ্রাজুয়েট প্রোগামে একা একটি মেয়ে পড়তে আসার অভিজ্ঞতা (সাউথ ডাকোটা) একসময় তিনি লিখতে শুরু করেন। এবং তার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘প্রবাসে’ নামে ২০১৫ সালের ‘একুশে বই মেলায়’ তার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি কোন তথ্যমূলক বই নয় বরং বলা যায় এটি লেখিকার রোজকার ডায়েরী।