মেক্সিকান সুমো কুস্তিগিরটাকে পুলিশ কেন ধরেছিল আমার ঠিক জানা নেই। তবে শুনেছি আমেরিকার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে মেক্সিকানদের অবদান অপরিসীম। ড্রাগ ট্রাফিকিং, অস্ত্র ব্যবসা, পতিতাবৃত্তি কোনটিতেই তারা পিছিয়ে নেই। মেক্সিকান মেয়েরা দেখতে ভাল। উজ্জ্বল ত্বক, গায়ের রঙ অনেকটা এশিয়ান ফর্সা মেয়েদের মত। চোখ–নাক একটু বোঁচা বোঁচা হলেও বেশ আবেদন আছে।

আমি ধরে নিলাম সুমো কুস্তিগিরটা নিশ্চয়ই এরকম কিছু করেছিল। বিদেশে যেটা হয়। নিজের পরিচয় বলে কিছু থাকে না। দেশের পরিচয়ে পরিচিত হতে হয়। আবার উল্টাটাও হয়। একজনকে দেখে আমরা গোটা দেশটাও বিচার করি। পাকিস্তানে তালেবান আছে তার মানে কোন পাকিস্তানিকে দেখলেই আমাদের তালেবান মনে হয়। মুসলিম দেশগুলোতে অনেক হাঙ্গামা হয় তার মানে সব মুসলিমই হাঙ্গামাকারি। এক ইন্ডিয়ান তোমার সাথে ভাল আচরণ করেনি, অন্যজন হয়ত খুব ভাল, তোমার সাথে হ্যান্ডসেক করতে হাত বাড়াবে কিন্তু তুমি ভাববে নিশ্চয়ই সে খামচি দিতে হাত বাড়িয়েছে।

প্রফেসররাও ছাত্র নেওয়ার সময় রেকর্ড দেখে। দেখা গেল তোমার দেশের সব ছেলে যারা ওনার ছাত্র ছিল খুব ভাল কাজ করে গেছে। কিন্তু তুমি সেরকম নও, নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও। তারপরও তোমার প্রেফারেন্স বেশি কারণ প্রফেসরের এর ধারণা বাকীদের মত তোমার দেশের সবাই খুব পরিশ্রমী। সুমন নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভাইয়া উনি পি এইচডি তে ছিলেন। কানাডাতে পি আর পাওয়ায় একদিনের নোটিশে চলে গেলেন। প্রফেসরতো রেগে আগুন। বাঙালীরা সবাই হায় হায় করতে লাগল। সুমন এটা কি করল! আর কোন বাংলাদেশিকে উনি নিবেন? সুমন তো আমাদের রেপুটেশনটাই নষ্ট করে দিল। সুমন ভাই এসব রেপুটেশন এর তোয়াক্কা করলেন না। তল্পিতল্পা গুছিয়ে কানাডায় হাঁটা দিলেন। আমেরিকাতে এখন অর্থনৈতিক মন্দা। কখন কি হয় বলা যায় না। তার চেয়ে কানাডায় নিশ্চিন্ত জীবন।

তবে এই অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব মনে হয় আমেরিকানদের থেকে ইন্টারন্যাশনাল ছাত্রদের উপরই বেশি। ইন্টারন্যাশনাল ছাত্রদের ফান্ড নিয়ে সব জায়গায় টানাটানি। আমেরিকানদের উপর মন্দার কোন প্রভাব দেখি না। সাউথ ডাকোটার অধিকাংশ মানুষই গেরস্থ পরিবার, চাষ বাস করে। কিন্তু তাদের জীবন যাপন দেখলে সেটি মনে হয়না। প্রত্যেকের বাড়ির সামনে চার-পাঁচটা করে গাড়ি। সুপার স্টোরে যখন বাজার করে, জিনিসপত্রে তাদের কার্ট উপচে পড়ে। শুনেছি একজন আমেরিকান বাচ্চা নাকি বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা নিয়ে জন্মায়। তবে এ নিয়ে বোধ হয় তাদের বিশেষ মাথা বাথা নেই। এরা হল ধার করে ঘি খাওয়া জাতি। একজন আমেরিকান প্রতিদিন যে পরিমাণ খাবার নষ্ট করে সেটি আমাদের চিন্তার বাইরে।

এদেরকে দেখলে আমার খুব আফসোস হয় আহারে আমাদের দেশটা যদি এরকম করা যেত। কারো স্বপ্ন যেমন থাকবে ডাক্তার হওয়ার। তেমন কারো স্বপ্ন থাকবে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হবার। তার স্বপ্নের সবটুকু জুড়ে থাকবে কোথাও যেন একটুকরো ময়লা না থাকে। পরিচ্ছন্নতা কর্মী বলে তার জীবনে কোন আক্ষেপ থাকবেনা কারণ জীবন ধারণের সব সুযোগ সুবিধাই তো সে পেয়েছে। বরং ডাক্তার হবার জন্য খটমট বই তাকে পড়তে হয়নি। আমাদের দেশে সবাই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। অধিকাংশই সেটি হতে পারে না কিন্তু তাতে কি? তার চিন্তা ভাবনা ঐ পর্যায়ের থেকে যায়। সেই চিন্তা ভাবনা তাকে চাষা হতে নিষেধ করে, বাপের মুদি দোকানে বসতে নিষেধ করে। ম্যাট্রিক পাস আইএ পাস লোক চাষা হলে শিক্ষা দীক্ষার অমর্যাদা করা হয়। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এসব চিন্তা ধারা বদলাতে হবে। তবে এসব নিয়ে ভাবতে গেলে আমার মাথা আউলে যায়। তবু প্রায় ভাবি। আমেরিকার জীবন নিয়ে যখন ভাবি তখন মনে হয় নিশ্চয়ই আমেরিকা আগে এরকম সাজানো গোছানো ছিল না। এখন হয়েছে। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবির দেশে কবিতার দেশে বইটি পড়ে ভুল ভাঙে। আমি যেরকম আমেরিকা দেখছি, সেই ৫০ বছর আগে সুনীলও ঠিক এরকমই সাজানো গোছানো আমেরিকা দেখেছেন।

আমেরিকা নিয়ে আমার ভাবনা চিন্তা দীর্ঘ হতে থাকে। দিনও এখন আস্তে আস্তে দীর্ঘ হচ্ছে। জুলাই মাস পড়তে আর কয়েকদিন বাকি। সূর্যের তাপও বাড়ছে বেশ। তবে বেশ হাওয়া হতো। হাওয়ার কারণে গরমটা অত বুঝতাম না। সুরিয়ার বাসায় আমরা এসি চালাতাম না। তাতে বিল বেশ কম আসত। সুরিয়া মিনেসোটা থেকে ফিরেছে। ওর কাছে শুনলাম সাজ্জাদের তিন তারিখে ডিফেন্স। নাসরিন যাবার পর সাজ্জাদের সাথে আমার কোন যোগাযোগ হয়নি আর। আশিক ও গেছে দেশে বিয়ে করতে। কামরান নাকি ট্রান্সফার হয়ে টেক্সাস যাচ্ছে। ডিপার্টমেন্টে শরীফ ভাইয়ের সাথে একদিন দেখা। উনিই বললেন।

আমাদের ল্যাব থেকে একদিন একটি পটলাক পার্টির আয়োজন করা হল। পটলাকে কি আনা হবে এই নিয়ে মেনু ঠিক করা হল। আমি কাবাব আনতে চাইলাম। নেপালিরা বললো ওরা মম আনবে। মম নেপালের ট্রাডিশনাল খাবার। অনেকটা আমাদের দেশের পুলি পিঠার মত। তবে ভেতরে সবজি মাংসের পুর দেওয়া থাকে। মম বানান বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার তাই নেপালি ছেলেগুলো বললো, ওরা চারজন মিলে মম আনবে। অমেয়া আনবে চিকেন সিক্সটি ফাইভ। পার্টির দিন সকালে ছিল ডিস্ক গলফ খেলা। অমেয়া একটা স্লিভলেস গেঞ্জি পরে এসেছে। সেটি দেখে ডক্টর হেলডার বললেন, অমেয়া তোমাকে ভীষণ সেক্সি দেখাচ্ছে। এ নিয়ে অনেকক্ষন হাসাহাসি হল। সকাল থেকে ১২টা পর্যন্ত আমরা খেললাম। ওখানে একটা বাস্কেট বলের কোট ছিল। খেলা শেষে সবাই ওখানে বল ফেলার চেষ্টা করছিল। মারকটও চেষ্টা করছিল কিন্তু উচ্চতার কারণে পারছিল না। ল্যারি হঠাৎ মারকট কে কোলে নিয়ে উঁচু করল। এবার সে পারল। সবাই খুব মজা পেল তবে আমি ওদের নির্লজ্জতায় হতবাক হয়ে গেলাম। এর মাঝে আমি জেনে গেছি ল্যারি আর মারকটের গভীর প্রেম। তারা একই বাড়িতে থাকে। যেদিন শুনেছি, আমি খুব অবাক। ল্যারির বয়স চল্লিশের উপরে। যদিও তার জিম করা স্বাস্থ্যের কারণে বেশ সুপুরুষ দেখায় তাকে। তবুও এই রাগী বুড়ো ভামের প্রেমে কোনভাবেই পড়া যায় না। মারকটের মত একটি লক্ষ্মী মেয়ে কেন এই ভুল করল বুঝলাম না। তবে ল্যারির সাথে প্রেম করে সে কিছু সুবিধা অবশ্যই পেয়েছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির এগারো তারিখে যখন একটি নতুন স্যাটেলাইট লঞ্চ করা হল। খুব বিখ্যাত ব্যক্তিরা সেদিন দাওয়াত পেলো। ক্যালিফোর্নিয়ার সেই অনুষ্ঠানে বিখ্যাতদের সাথে অখ্যাত মারকটও গেলো।

খেলা শেষে আমরা সবাই হাঁপিয়ে গেছি। খিদেও পেয়েছে বেশ। হিলক্রেস্ট পার্কে জড় হলাম আমরা। এখানকার পার্কগুলো বেশ ভাল। প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারতে প্রকৃতির মাঝে যেতে হয়না, ব্যবস্থা আছে। খাবার দাবার আগেই গরম করে আনা হয়েছিল। রায়ান হরিণের মাংস এনেছে। হরিণটি সে নিজেই শিকার করেছে। ফ্রাঙ্ক এনেছে আইস্ক্রিম। জ্যাক চিজ কেক। প্রফেসর এরন এনেছেন ফ্রুট সালাদ, ফলমূল দিয়ে ঘণ্ট পাকানো একটা জিনিস। ল্যারি এনেছে গ্রিল চিকেন উইংস। সারারাত জেগে এটি সে রান্না করেছে। মারকট করেছে থাই কারি আর রাইস। ডক্টর হেলডার এনেছেন চিকেন ফ্রাই আর কুকিস। হেলডার এর ওয়াইফ সুসান ও এসেছে। ওনার সাথে ওনাদের নাতনিও এসেছে। হেলডারের ছোট মেয়ে বাচ্চাটিকে চায়না থেকে দত্তক এনেছেন। বাচ্চাটির বয়স পাঁচ। কিন্তু আড়াইয়ের মত দেখায়। জন্মগত কিছু ত্রুটির কারণে তার শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি এতটা হয়নি। দেখতেও বেশ অনাকর্ষণীয়। বাচ্চাদের দেখলেই সাধারণত আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে আদর করি। সব বাচ্চার মধ্যে একটা নিষ্পাপ সরলতা থাকে। কিন্তু এই বাচ্চাটির মধ্যে তেমন কিছু দেখলাম না। আমার ইচ্ছেও করছিলনা কোলে নিতে। তবে হেলডার আর তার বউ বাচ্চাটিকে নিয়ে এত আহ্লাদী করছিল যে আমাকেও কোলে নিতে হল। কিছুক্ষণ কোলে নিয়ে সুযোগ বুঝে আমি হেলডার এর কাছে গছিয়ে দিলাম।

বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে হেলডার খেলার ফলাফল ঘোষণা করলেন। সবচেয়ে বাজে খেলার জন্য আমি একটি বার্বি ডল পেলাম। নাড়া দিলেই ডলটিতে আলো জ্বলে ওঠে। চিকেন সিক্সটি ফাইভ খেতে খুব ভাল লাগলো আমার। আমি অমেয়ার বউকে জিজ্ঞেস করলাম এটির নাম চিকেন সিক্সটি ফাইভ কেনো। সে বললো, ৬৫ টি মসলা একসাথে চিকেন সিক্সটি ফাইভ নামে পাওয়া যায়। আমি গুনে গুনে বারো –তেরোটির বেশি মসলার নাম মনে করতে পারলাম না। আমি বাসায় সুরিয়ার জন্য কিছু খাবার এনেছিলাম। হরিনের মাংসটি সুরিয়া খুব আগ্রহ ভরে খেল। বললো, মজা তবে একটু টকটক।

সাজ্জাদের ডিফেন্স শেষ। এর মাঝে সে একদিন ফোন দিল। তারা মাউন্ট রাসমোরে ও আরও কয়েকটি জায়গায় বেড়াতে যাবে। আমি যেতে চাই কিনা। আমার একটু একটু যেতে ইচ্ছে করছিল। মাউন্ট রাসমোরের গল্প আমি অনেক শুনেছি। ওখানে জর্জ ওয়াশিংটন সহ চারজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট এর মূর্তি পাহাড়ের গায়ে খোদায় করা আছে। কিন্তু আমি আগেই অরিগনের টিকেট কেটে ফেলেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা আমেরিকাতে পড়ে তাদের একটা গেট টুগেদার হবে ওখানে। দু’বার ঘুরলে বেশি খরচ হয়ে যাবে। তাছাড়া সব ফ্যামিলি যাচ্ছে মাউন্ট রাসমোরে। সব জোড়ার মধ্যে নিশ্চয়ই আমরা একা ঘুরতে ভাল লাগবে না। আমি সাজ্জাদকে জানিয়ে দিলাম যাব না।

নাসরিনের সাথে আমার ফেসবুকে মাঝে মাঝে যোগাযোগ হত। সে প্রত্যেকটি ম্যাসেজে বলত, বাসা খুঁজে পেয়েছি কিনা। আমি তাকে বলতাম, এইতো দেখছি, পেয়ে যাবো নিশ্চয়ই। আমার এইতো দেখছিতে নাসরিনের মন ভরছিলনা। আমাকে ভীষণ ঝাড়ি দিয়ে সে বললো, আমি না থাকলে কিছুই হয়না। তোর দ্বারা কখনোই কিছু হবে না। আমি হোসেনকে বলে দিচ্ছি, ও আমাদের বাসা খুঁজে দিবে। এর মাঝে খুব ঝক্কি ঝামেলা গেছে। সবটা একাই সামলেছি। আর বাসাতো দেখছিলাম আমি। তবে দূরত্ব ও ভাড়ার ব্যাপারটা মাথায় রাখাতে সুবিধাজনক কিছু পাচ্ছিলাম না। কিন্তু নাসরিন সেটি বুঝল না। এসব সাধারন কাজের কোন স্বীকৃতি নেই ওর কাছে। ঘন ঘন আমাকে তাগাদা দিতে লাগল আর আমি যে একটি আমড়া কাঠের উৎকৃষ্ট ঢেঁকি ছাড়া কিছুই নই মনে করিয়ে দিতে লাগল। বেশ মেজাজ খারাপ হল আমার। তবু শান্ত ভাবে বললাম, এত বার বলতে হবে না। সময় তো আছে, নিশ্চয়ই পেয়ে যাব ।

এর মাঝে নাসরিন একটি ভাল খবর দিল। ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। ওর বয়ফ্রেন্ড আশরাফের সাথেই বিয়ে। আশরাফ আমার ক্লাসমেট ছিল। নাসরিনের বিয়ের কথা শুনে আমার মায়ের মাথা খারাপ হয়ে গেল। উদ্ভট সব পাত্র এনে আমাকে জ্বালাতন করা শুরু করল। কোন পাত্র আমার পছন্দ না হওয়াতে, ওনার ধারণা হল, আমেরিকা যেয়ে আমি নিজেকে মহারানী ভিক্টোরিয়া মনে করছি, কাউকেই মানুষ মনে করছি না। সাজ্জদের ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভারসিটিতে পি এইচ ডি তে ভর্তি হয়েছে। ও চলে যাবে। আমি ওকে ইফতারির আর ডিনারের দাওয়াত করলাম। সুরিয়ার তাতে কোন অসুবিধা আছে কিনা জিজ্ঞেস করলাম, সে বললো নেই। সাজ্জাদকে একা বাসায় ডাকলে খারাপ দেখায়, সাথে অন্য কাউকে ডাকা দরকার, সুরিয়া বললো, তুমি কামরানকে ডাকছোনা কেন? কামরানও তো চলে যাচ্ছে। কামরানকে আমি ডাকলাম না। কামরানকে আমার খুব অপছন্দ। অপছন্দের কারণ সে ফেসবুকে মেয়েদের নিয়ে কিছু খারাপ কথা লিখে ছিল। মেয়েদের নিয়ে যার এত অশ্রদ্ধা, তাকে মেয়েদের বাসায় ডাকার কোন মানে হয় না। পরে অবশ্য আমার খুব অনুশোচনা হয়েছিল, এমনটা হয়ত না করলেও পারতাম।

অবশেষে হোসেনকে ডাকা হল। সারাদিন আমি একাই খেটেখুটে অনেক রান্না করলাম। সাজ্জাদের ধারণা ছিল আমি কিছুই পারি না। আমাদের বাসার দাওয়াতে নাসরিন সবসময় রান্না করত। সাজ্জাদ খুব বেশি কিছু খেল না। সাজ্জাদ এমনিতে খুব কম খায় সবসময়। তবে হোসেন প্রচুর খেল। তার কাছে অনেকগুলো খাবার পার্সিয়ান খাবারেরর মত লেগেছে অনেকটা। এই বলে সে পার্সিয়ান ঐতিহ্য নিয়ে গল্প শুরু করল। আমরা খুব কষ্ট করে ওর পুরনো গল্প শুনলাম।

সাজ্জাদের চলে যেতে আর কয়েকদিন বাকি। এর মধ্যে ও  গ্রাজুয়েশন পার্টি দিল। ততদিনে রোজা এসে গেছে। রোজার মধ্যেই পার্টি। বারবিকিউ দিয়ে ইফতারি করা হবে। ঐদিন সে আমাকে নিতে আসল। অনেকদিন পর আমি সাজ্জাদের গাড়িতে উঠলাম। সাজ্জাদ যাবার আগে ওর পড়ার টেবিল আর চেয়ারটা আমাকে দিয়ে গেল। ইমন নামে এক ভাইয়া চলে যাচ্ছিল। তার কাছ থেকে একটা ম্যাট্রেস নিয়ে রাখলাম নাসরিনের জন্য। সাজ্জাদের গাড়িতেই আনা হল। সাজ্জাদ সেটি বাসার ভিতরে একাই টেনে আনল।

সাজ্জাদ চলে যাওয়ায় বেশ মন খারাপ হল আমার। অনেকটা অভিভাবক শূন্য মনে হল নিজেকে। সুরিয়ারও মন খারাপ হল। ও বললো, এত ভাল ছেলে ছিল, একে তুমি বিয়ে করলেই পারতে। এমনিতে সবসময় আমার বিয়ে নিয়ে খুব কথা হত। নাসরিনের বিয়ে হওয়াতে সবাই আরও বেশি করে আমার বিয়ের কথা বলতে লাগল। একারণে ফ্যামিলি হাউজিঙে দাওয়াত থাকলেও আমি যেতাম না। তবে ভাবীরা খুব আন্তরিক ছিল। কান্তা আপু মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে আমার সাথে গল্প করত। একদিন উনি আমাকে দাওয়াত দিলেন। আমার ধারণা ছিল কান্তা আপু তেমন রান্নাবান্না পারে না। সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকে।

কান্তা আপুর বাসায় ইফতারি করলাম। রান্নার হাত বেশ ভাল আপুর। ইফতেখার ভাইয়ের পরিবার আর মিঠু ভাইয়েরও দাওয়াত ছিল। মিঠু ভাই এলেন বেশ দেরি করে। মিঠু ভাই বেশ বয়স্ক লোক। পঞ্চাশের উপরে হবে ওনার বয়স। সুইডেন থেকে এখানে এসে রেস্তোঁরা দিয়েছেন। ইটালিয়ান এন্ড ইন্ডিয়ান ফুড। কারণ ছোট শহর, বাংলাদেশি ফুড বললে রেস্তোরা এখানে চলবে না। মিঠু ভাই অনেক গল্প করলেন। ওনার প্রতিটা গল্প খুব হাসির। পেট ব্যথা হবার জোগাড়। দেশের গল্প হল অনেক। ইফতেখার ভাই গিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে বাঙালি দূতাবাসে পাসপোর্ট রিনিউ করতে। ওখানে ওনাকে নাকি হয়রানি করা হয়েছে। সে গল্প বললেন। একসময় রাজনীতির গল্প আসলো। শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে কথা হল। কান্তা আপুর হাসবেন্ড আর মিঠু ভাই রীতিমত তর্ক বাঁধিয়ে ফেললেন।

গল্পে গল্পে রাত হল অনেক। কান্তা আপু আমাকে বাসায় পৌঁছে দিলেন। বাসায় পৌঁছালাম। সুরিয়া বললো সে কিছু জিনিস পত্র দেখেছে। অনলাইনে বেশ সস্তা। এক লিবিয়ান ফ্যামিলি চলে যাচ্ছে। যাবার আগে সস্তায় বেচে দিচ্ছে আমি নিতে চাই কিনা। চাইলে আমরা কাল যেতে পারি। বাসার কাছেই। আমাদের বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের পথ। বাসার পিছনের স্কুলটা পেরোতেই বাসাটা। দরজা নক করতে হেজাব পরা একটি মহিলা খুলে দিল। মহিলার চোখ গাঢ় সবুজ আইশ্যাডোতে ঢাকা। মনে হল বাসায় উনি এমন সেজেগুজেই থাকেন। কারণ তার পরনে ম্যাক্সি টাইপ কিছু ছিল। বাসার ভিতরে ঢুকলাম। বাসার ভিতরে ঢুকে রীতিমত অবাক আমরা।

বেশ আলিশান ডুপ্লেক্স বাসা। টিভি চলছে। দুটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে সেখানে কার্টুন দেখছে। আমরা যাওয়াতে তারা ছুটে এল আমাদের কাছে। ভদ্রমহিলা আমাদেরকে উপরতলায় ও বেজমেন্টে নিয়ে গেলেন কি কি জিনিস বিক্রি করবেন দেখাতে। আমেরিকার মত দেশে কোন বিদেশি ছাত্রের এত সৌখিন আসবাব দেখে রীতিমত অবাক হলাম। ভদ্র মহিলার সাথে আমাদের বেশ গল্প হল। উনি সুরিয়ার থেকে আমার সাথে বেশি গল্প করেছিলেন। ভদ্র মহিলার হাসবেন্ডের পি এইচ ডি শেষ। তাই লিবিয়াতে ফিরছেন তারা। তাছাড়া তাদের যুদ্ধও শেষ। তাই দেশেই ফিরতে চান তারা।

আমরা কি কি জিনিস নিব, বুকিং দিয়ে আসলাম। কারণ মহিলা বললেন তার স্বামী উপস্থিত না থাকলে তিনি বিক্রি করতে পারবেন না। বাসায় ফিরে সুরিয়া বললো, দেখেছো তুমি মুসলিম বলে, তোমাকে কি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন। আমার সাথে কোন কথাই বললেন না। কি অদ্ভুত ব্যাপার। আমি প্রসঙ্গ ঘুরাতে বললাম, আচ্ছা এরা এত টাকা কোথায় পায় বলত, এদের বাসা তো রাজপ্রাসাদ বলে মনে হল। যদিও আমি আগেই আঁচ করেছিলাম। তবে সুরিয়া সবটা বুঝিয়ে বললো।

আমরা যেমন আমেরিকান সরকারের টাকায় পড়ি। কিন্তু আরব দেশগুলো এই যে মিশর, কাতার, সৌদি আরব, লিবিয়া এদেরকে পড়ায় এদের দেশের সরকার। তুমি কি জান মথু যে ছেলেটির সাথে থাকে, আরব সরকার ওকে প্রতি মাসে ৪০০০ ডলার দেয়। ওদের দেশে শিক্ষার হার তত বেশি নয়। কিন্তু টাকার তো আর অভাব নেই। তেল বিক্রির টাকা। তাই ওদেরকে পড়তে পাঠায়। এদিকে ওরা আসলে আমেরিকানদের ও লাভ। টিউশন ফি বাবদ আমেরিকান সরকারকে ওরা অনেক টাকা পে করে।

আমি আর সুরিয়া দুজন দুটি খাট আর নাসরিনের জন্য একটি সাইকেল কিনতে চাই। লিবিয়ান ভদ্রলোকের নাম হাকিম। হাকিম কে ফোন দিয়ে বলা হল, আমাদের গাড়ি নেই, জিনিসপত্র গুলো আমাদের বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। হাকিম বললো, ঠিক আছে আমার বড় গাড়ি আছে। তবে সাথে কোন পুরুষ নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে তিনি সাহায্য করতে পারবেন না। হাকিম এর এই অদ্ভুত আচরণ খুব অসুবিধায় ফেলল আমাদের। আমরা কোন ছেলে জোগাড় করতে পারছিলাম না। অবশেষে হোসেন রাজি হল।

হোসেন এর জন্য সেদিন আমরা কাপ্সা রান্না করেছিলাম। হোসেন আমাদের জন্য জুস এনেছিল। এ পর্যন্ত যতদিন সে আমাদের বাসায় এসেছে। কোনদিন খালি হাতে আসেনি। কোন না কোন খাবার নিয়ে এসেছে। ইরানি কালচার অনুযায়ী নাকি কারো বাসায় গেলে কিছু নিয়ে যেতে হয়। হাকিম বললো, সে বিকেলে থাকবে। আমরা যেয়ে অনেক্ষন বসে আছি। হাকিমের দেখা নেই। সে নাকি কাজে আটকে গেছে। বেশ বিরক্ত হয়ে আমরা ফিরে এলাম।

জিনিসপত্রের দাম আগেই পরিশোধ করা হয়েছে। এখন হাকিম ফোন দিলেই হাকিম ব্যস্ততার কথা বলে। সুরিয়া বললো, আমার ধারণা হাকিম আমাদের টাকাটি মেরে দিয়ে লিবিয়া চলে যাবে। আরবের লোকদের সম্পর্কে আমি কোনোদিন ভাল কথা শুনিনি। আর তুমি দেখ,কদিন পরই তো হাকিমের লিবিয়া চলে যাবে। টাকা আগে পরিশোধ করায় সে আফসোস করতে লাগল। পরদিন দেখি হাকিম তার বিশাল ট্রাক নিয়ে এসেছে। দেরির জন্য সে ভীষণ দুঃখ প্রকাশ করল। হাকিম অনেক জিনিস এনেছে। আমরা অনেক কিছু কিনিনি, সেগুলোও এনেছে। সব কিছু সে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিল। হাকিমের সাথে তার আট বছরের ছেলে এসেছে। ছেলেটি বেশ চটপটে। সেও অনেক টানাটানি করল।

তারপর আমরা চারজন মিলে খাট গুলো সেট করে ফেললাম। খাটের সাথে হাকিমের বউ বিছানা বালিশও দিয়েছিল। হাকিম বললো, এগুলি সব ধোয়া। তার স্ত্রী কেঁচেই পাঠিয়েছে। ছেলেটি বললো, এটি আমার খাট, আমি এটিতে ঘুমোতাম। ছেলেটিকে আমি চকলেট দিলাম। অনেকবার বার না বলে তারপর সে নিল। সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে ওরা চলে গেল বিদায় নিয়ে। বাচ্চাটির জন্য আমার খুব মায়া হচ্ছিল আর কোনদিন দেখা হবে না ভেবে। খুব ইচ্ছে করছিল বাচ্চাটি একটু আদর করে দেই। কিন্ত আরব কালচারে এটি কেমন দেখায় আমার জানা ছিল না। তাই ইচ্ছে সংবরণ করলাম।

পরদিন সুরিয়া গেছে জেসমিনদের বাসায় । হাকিম বললো সে সন্ধ্যার পর একটু আমাদের বাসায় আসতে চায়। আমি হাকিম আর তার ছেলের জন্য কিছু খাবার বানালাম। ওরা খেজুর ছাড়া কিছু খেল না। অনেক জিনিসপত্র দিয়ে গেল আমাকে। জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল ছেলেমেয়েগুলোর স্কুল ব্যাগ, রংপেন্সিল, কলম, কিছু খেলনা বার্বিডল, থালা বাসন আর বিছানা বালিশ। হাকিম বললো, এগুলো সব তার বাচ্চাদের জিনিস। ফেলতে ভীষণ মায়া লাগছে। তাই আমাদেরকে দিয়ে যাওয়া।

থালাবাসন ছাড়া কোনটিই আমার কাজের নয়। তবু আমি আগ্রহভরে নিলাম। আমার কাছ থেকে ওরা শেষ বিদায় নিল। কারণ গাড়িটি তারা আজ রাতে বেচে দিবে। আর পরশু সকালে তাদের ফ্লাইট। তাই আর দেখা হবে না। ওদেরকে আমি পার্কিং লট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ওরা চলে যাবার পর ও অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। কেমন যেন শূন্য লাগলো। সত্যি কি আর দেখা হবে না। বাইরে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া ছিল। আমি ঘরে চলে আসলাম।

সুরিয়া এসে এত জিনিস দেখে ভীষণ বিরক্ত। বললো সব তো কাজের নয়। বিছানা বালিশ আর থালা বাসন ছাড়া চলো বাকিগুলো ফেলে দেই। আমি কিছু ফেললাম না। হাকিমের বাচ্চাদের জিনিসগুলো আমার খাটের নিচে রয়ে গেল।

 


প্রবাসে সিরিজের গল্পসমূহঃ

 পর্ব ১ঃ যাত্রাপথের গল্প
 পর্ব ২ঃ নতুন বাসা, ওরিয়েন্টেশন, রাস্তা হারানো
 পর্ব ৩ঃ পুলিশ আসা, রেজিস্ট্রেশন বিড়ম্বনা
 পর্ব ৪ঃ ডরমেটরির গল্প, প্রথম তুষারপাত
 পর্ব ৫ঃ ইন্টারন্যাশনাল নাইট, বাসা নিয়ে ঝামেলা, শায়লা আপুর চলে যাওয়া
 পর্ব ৬ঃ কামরানকে হাসপাতালে নেওয়া, টেকো সুদীপ আর ব্রিটিশ প্রফেসরের গল্প
 পর্ব ৭ঃ ল্যাব ও ফরাসী যুবকের হৃদয় ভাঙার গল্প।
 পর্ব ৮ঃ সামার এসেছে, বেতন পাইনি, প্রথম বাসা ছেড়ে দিলাম
 পর্ব ৯ঃ সঙ্গীহীন জীবন, সুরিয়া মথুর গল্প, সামারের দিনলিপি, একা পথ চলা
 পর্ব ১০ঃ বিদেশী ভাষা শেখা ও আমেরিকান চাষাবাদের গল্প
 পর্ব ১১ঃ আমার বাইবেল শেখা।
 পর্ব ১২ঃ সাজ্জাদের চলে যাওয়া, লিবিয়ান পরিবারের গল্প
 পর্ব ১৩ঃ মুহিত ভাইয়ের গল্প, আমার আগুন ধরিয়ে ফেলা
 পর্ব ১৪ঃ মসজিদ, ঈদ, ইয়ামিনী আসা, নতুন বাসা, আমেরিকান বিয়ে ও অরিগন যাবার গল্প
 পর্ব ১৫ঃ
 পর্ব ১৬ঃ
 পর্ব ১৭ঃ
 পর্ব ১৮ঃ
 পর্ব ১৯ঃ

লেখক পরিচিতিঃ

 জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ ক্যারোলিনা এ এন্ড টি স্টেট’ ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ‘PhD’ করছেন এবং তার গবেষণার বিষয় হল ‘Real time Object detection with Higher Accuracy’। jannatunজান্নাতুন নাহার তন্দ্রার স্কুল জীবন কেটেছে চুয়াডাঙ্গা শহরে, কলেজ জীবন হলিক্রস কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। এবং সেখান থেকেই ২০১০ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষে ২০১২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং ২০১৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা অবসরে লিখতে ভালবাসেন এবং সে অভ্যাস বশতই আমেরিকার গ্রাজুয়েট প্রোগামে একা একটি মেয়ে পড়তে আসার অভিজ্ঞতা (সাউথ ডাকোটা) একসময় তিনি লিখতে শুরু করেন। এবং তার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘প্রবাসে’ নামে ২০১৫ সালের ‘একুশে বই মেলায়’ তার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি কোন তথ্যমূলক বই নয় বরং বলা যায় এটি লেখিকার রোজকার ডায়েরী।