ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে খুব সকালে ডিপার্টমেন্টে চলে যাই আমরা। ডিপার্টমেন্টের তাপমাত্রা সবসময় পঁচাত্তর ডিগ্রি ফারেনহাইট থাকে। আমেরিকানদের দেখি পাতলা কিছু পরে ঘোরে। তবে আমার ডিপার্টমেন্টের ভিতরেও সোয়েটার লাগে।

একটা কুইজ ছিল, দিলাম। এসাইনমেন্ট ছিল, জমা দিয়ে বিকেলে বাসায় ফিরেছি। বাড়িয়ালা হিটার ঠিক করে দিয়েছে। আমি বাথরুমে এক ঘণ্টা গা ডুবিয়ে বসে থাকি। রাতের পার্টির জন্য তৈরি হই আমরা। নাসরিন আমাকে সাজিয়ে দেয়। একটা মেরুন রঙের সালোয়ার কামিজ পরি। শায়লা আপু কোন সাজগোজ করে না। মনির ভাই এসে আমাদেরকে স্যারের বাসায় নিয়ে যায়। যাবার আগে নাসরিন স্নো এর মধ্যে সেলফি তোলে।

রফিক স্যারের বাসায় ঢুকেছি। সুন্দর ডুপ্লেক্স বাসা। ছেলেরা নিচে মেয়েরা উপরে বসেছে। ঘর আলো করে ঝলমলে তরুণীরা বসে আছে। প্রত্যেকটি মেয়েকেই ভীষণ সুন্দর মনে হয় আমার। আমি তাদের রূপে, সাজগোজে, শাড়ির কারুকার্যে মুগ্ধ হই। নিজেকে খুব বেমানান লাগে। রফিক স্যারের বউ আমাদের খেতে বলে। বুফে সিস্টেম। আমি খাবার খেয়ে মুগ্ধ হই। নাসরিন ভাবীদের সাথে পরিচয় করে। রফিক স্যারের বউকে জিজ্ঞেস করে পায়েসটা কিভাবে রেঁধেছে, মিষ্টি বানানোর সময় আগে ছানা করে নিয়েছে কিনা। খুব আলাপ জমিয়ে ফেলে ও। আমি মুগ্ধ হয়ে নাসরিনের আলাপ শুনি। স্যারের বউকে খুব ভাল লাগে আমার। হেজাব পরা ভদ্র মহিলা; সারাক্ষণ ছোটাছুটি করছেন। শায়লা আপু বাচ্চাদের নিয়ে খেলছে। সুন্দর একটা ঈদ কাটে আমাদের।

মনির ভাই বাসায় পৌঁছে দেয়। ফেরার পথে গল্প হয় ওনার সাথে। উনি বলেন সবকটি ভাবী দেখতেই মোটামুটি, কেউ তেমন জাতের নয়। আমরা ঘরে ফিরি। সবাই ফোনে ব্যস্ত হয়ে যাই।

ঈদের আরেকটা পার্টি হয়। পটলাক পার্টি। সবাই একটা করে ডিশ রান্না করে নিয়ে যায়। আমি আর নাসরিন পোলাও করি। আমরা দুজনেই সবুজ জামদানি পরি। সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করে আমরা এক শাড়ি কেটে দুজন পরেছি কিনা।  এরপর কয়েকদিন কেটে যায়। ইলেকট্রিক বিল পাই আমরা। বিল এসেছে স্বাভাবিক এর থেকে অনেকগুণ বেশী। বিল অফিসে ফোন করি। ওরা বলে বাসায় ইন্সুলেসন প্রবলেম থাকতে পারে। বাড়িয়ালাকে বললে তিনি বলেন, কোন প্রব্লেম নেই। অনেক বড় বাসা, সেন্ট্রাল হিটার তাই বিল বেশি আসছে। এরকম বিশ্রী বাসা খুঁজে দেয়ার জন্য নাসরিন সাজ্জাদকে অনেক গালাগাল করে।

এদিকে ইন্টারন্যাশনাল নাইট এসে পড়েছে। নাসরিন প্রোগ্রামের রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খিঁচুড়ী ছাড়া আর কোন ডিশ পায় না ও। সব ভাল ডিশ ইন্ডিয়ানরা নিয়ে ফেলেছে। ইন্ডিয়ানদের উপর ভীষণ রেগে যায় ও। তারপর ও আর রুমা আপু দুজন মিলে রান্না করতে যায়। আমি আমার সময় নেই বলে ডিপার্টমেন্টে চলে যাই। কোনকালেই আমার সময় হবে না বলে নাসরিন রাগারাগি করে।

ডিপার্টমেন্ট থেকে এসে দেখি আম্মু আমার জন্য লাল-সবুজ একটা শাড়ি পাঠিয়েছেন। নাসরিনের খালা নিউইয়র্ক এসেছেন। ওনার কাছে পাঠিয়েছেন। আমরা দুজন মহা আনন্দে পাঠানো জিনিসপত্র দেখি। শায়লা আপুকে দেখানোর জন্য ডাকি, উনি আসেন না। শাড়িটা খুব পছন্দ হয় আমার। কিন্তু নাইট পার্টিতে পরা যাবে কিনা বুঝতে পারি না। নাসরিন বলে পরা যাবে। তখন আমারও মনে হয় পরা যাবে।

নাসরিন আমাকে ফ্যাশান শোর জন্য বলে। আমি রাজি হতে পারিনা। নিজের দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে অনীহা দেখে ও খুব খেপে যায়। অনুষ্ঠানের দিন আসে। আমি লাল–সবুজ শাড়িটা পরে যাই। নাসরিন পরে বেগুনি কাতান। শায়লা আপুও শাড়ি পরে। জাম রঙের সিল্ক। সবাই আমাদেরকে ইন্ডিয়ান কিনা জিজ্ঞেস করে। খুব আলো ঝলমলে একটা অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠান দেখে খুব মন খারাপ হয় আমার। প্রোগ্রামের কোথাও বাংলাদেশের কিছু থাকে না। দেশের পতাকা ধরতে কেউ আমরা প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করি না। দেশের নামটা কোথাও নেই। খুব অনুশোচনায় ভুগি। তবে কলকাতার একটি ছেলে “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে” গানটি করে। ভিন্ন একটা দেশে বাংলায় গান শুনে অদ্ভুত আনন্দ হয়। বিদেশিদের মনে হয় ভাল লাগে না। মিউজিক এত ঠাণ্ডা কেন, ওরা বুঝে উঠতে পারে না। তবুও আমি, নাসরিন আর শায়লা আপু আশেপাশের সবাইকে গানের কথা বঙ্গানুবাদ করে বোঝাই, রবি ঠাকুর কে চেনাই। বলি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারী কেন, আমাদের ইতিহাসটা বলি। অধিকাংশ লোকে বলে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বলে এরকম কিছু আছে তাদের জানা নেই। খুব অবাক হই আমরা।

অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে শুনি, দুইটি বাঙালি ছেলে মারামারি করেছে। একজন রেগে গিয়ে পুলিশ ডেকেছে। পরে অন্যরা ব্যাপারটা মিটমাট করেছে। এ নিয়ে কিছুদিন খুব থমথমে অবস্থা বিরাজ করে।

এরপর বিভিন্ন নাইট করার হিড়িক পড়ে। ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশি, চাইনিজ, নেপালি, আফ্রিকান। নাইটগুলোতে সে দেশের সংস্কৃতি তুলে ধরা হয় ও সেই দেশের খাবার দেওয়া হয়। আমেরিকানরা খুব উৎসাহ নিয়ে এসব নাইটে যোগদান করে। নাসরিন প্রতিটি নাইটে যোগদান করে। আমাকে এসে গল্প বলে, যাচ্ছেতাই একটা অনুষ্ঠান, কি যে বাজে খাবার। আটা মুঠি মুঠি করে রাখছে, ঐটা নাকি ডেজার্ট আর আফ্রিকান মেয়েগুলো যদি দেখতিস গায়ে তো কিচ্ছু রাখে নাই। পরদিন নাসরিন আমাকে ডাকে, নেপালি নাইট যাবি নাকি, ভালই হবে মনে হয়। টিকেট কেটে ফেলেছি। কোন নাইট দেখেই নাসরিন সন্তুষ্ট হতে পারে না। অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নেয় এবার বাংলাদেশি নাইট করা হবে। সবাইকে দেখিয়ে দেবে আমাদের দেশের সংস্কৃতি কত ভাল। এ নিয়ে সে ফান্ড জোগাড়ের চেষ্টা করে। বেলার সাথে আলাপ করে। বেলা আন্ডারগ্রেডে পড়া বাংলাদেশি একটি মেয়ে। ও ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট কমিউনিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। সবাই জানে বাংলাদেশি একটি মেয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট। এই ছোট মেয়েটির কারণে অনেকে বাংলাদেশের নামটা জানে। আমার খুব ভাল লাগে মেয়েটিকে। মেয়েটি সবসময় এক ইন্ডিয়ান বুড়োর সাথে ঘোরে। ইন্ডিয়ান বুড়োটির বয়স পঞ্চাশের উপরে। এখানে পরিসংখ্যানে পি এইচ ডি করছে। মেয়ে দেখলেই গায়ে পড়ে কথা বলে। তার কথাবার্তা সিনেমার দিকে চলে আসে একসময়।  আমাকে একদিন বললো, তুমি বাঙালি? বাঙালি মেয়ে আমার খুব ভাল লাগে। বিদ্যা বালান আমার ফেভারিট। বুড়াটাকে আমার ভাল লাগে না।

প্রায় সপ্তাহেই আমাদের বাংলাদেশ কমিউনিটির মিটিং হয়। মিটিং এ সবার অভিযোগ ইন্ডিয়ান শুনতে শুনতে সবাই হাঁপিয়ে গেছে। বাংলাদেশিদের উপস্থিতি সবাইকে জানানো দরকার। আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে মিটিং করি। মিটিং শেষে সবাই বেলার ছোট ছোট জামার আর আচার আচরণের সমালোচনা করি। বেলা সব মিটিং এ থাকে না। ও এ সময় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করে। বেলাকে বেয়াদব বলে মিটিং শেষ করি।

আমরা এখন ভীষণ ব্যস্ত। ফাইনাল উইকের আর বেশি দেরি নেই। তবুও নাসরিন এর কাছে আমি ময়না ছলাৎ ছলাৎ নাচ শিখি। বাংলাদেশি নাইটের জোর প্রস্তুতি চালাই। শায়লা আপু আমাদের নাচ দেখে। মন্তব্য করে। সুন্দর সময় কাটে আমাদের। অনুষ্ঠানে বেলা গান গাইবে। নজরুল একাডেমীতে গান শিখেছে সে। সে নাচতেও পারে। নাচও করবে। আমার বেলার জন্য খুব মায়া লাগে, নাসরিনেরও লাগে। ও বেলাকে বলে, অনুষ্ঠানের দিন আমাদের বাসায় আসতে। এক সাথে সাজগোজ করব। আর একদিন বাসায় এসে খেয়ে যেতে।  বেলা কখনও আমাদের বাসায় খেতে আসে না, বাঙালিদের কোন প্রোগ্রামেও যায় না।

এদিকে পুরোদমে তুষারপাত শুরু হয়ে যায়। তবুও রাস্তাঘাট বেশ ঝকঝকে থাকে। তুষারপাত থামলে আমেরিকানরা বেরিয়ে পড়ে তুষার পরিষ্কার করতে। বাসার সামনের তুষার পরিষ্কার না করলে এখানে জরিমানা করা হয়। আমি আর নাসরিন ওয়ালমার্ট থেকে তুষার শেভেল কিনে আনি। দুইজন কাজে লাগি। পরিষ্কার করতে যেয়ে বুঝি কাজটা ভীষণ পরিশ্রমের। আমরা হাঁপিয়ে যাই। আমাদের পাশেই এক বুড়ি মহিলা উনিও পরিষ্কার করছেন। উনি হাঁপাচ্ছেন না। একদমে অনেকটা পরিষ্কার করে ফেলেছেন।  লজ্জা পেয়ে, আমরা উঠে পড়ি। আবার পরিষ্কার করি। একসময় তুষারে ঢাকা জায়গাটার মধ্যে থেকে আমরা রাস্তা বের করে ফেলি। আমাদের বাসার পাশের দিকটা আমাদের বাড়িয়ালা পরিষ্কার করে দেন। রেস্টুরেন্টার মালিকও উনি। একটা স্নো ক্লিনিং গাড়ি আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যায় তুষারে ঢাকা পার্কিং লট। এক পাশে সব স্নো জমা করে। উঁচু পাহাড়ের মত বানিয়ে ফেলে। আমার আর নাসরিনের খুব ইচ্ছে করে ঐ পাহাড়ে উঠে একদিন গড়াগড়ি দেই। শায়লা আপুর এরকম ইচ্ছে করে না।

একদিন শায়লা আপু জানায়, উনি দু’সপ্তাহ পর মিনেসোটা চলে যাচ্ছেন চাচার বাসায়। কাগজপত্র সব রেডি। আমরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ি। নাসরিন খুব রেগে যায়, আমিও খুব রেগে যাই। আমাদের বাসা ভাড়া অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি, নয়শ ডলার। বাসাতে বিল আসে প্রায় সাড়ে তিনশো ডলার। সামনে তুষারপাত বাড়লে হিটবিল আরও বেড়ে যাবে। আমরা রুমমেট খুঁজে পাবনা নিশ্চিত হই। কোন সিঙ্গেল মেয়ে খুঁজে পাই না। অনেক ছেলে আমাদের রুমমেট হতে আগ্রহ প্রকাশ করে।

আমরা বাড়িয়ালাকে বাড়িছাড়ার জন্য কনভিন্স করতে তার অফিসে যাই। রিসেপ্সনিস্ট মেয়েটি আমাদের সাথে খুব ভাল ব্যবহার করে। তার ব্যবহারে মনে হয় আমাদের মত আর কাউকে সে আগে দেখিনি। আমাদের সাথে কথা বলতে পেরে সে খুব আনন্দিত। আমরা আনন্দিত হতে পারি না। আনন্দিত হওয়ার ভান করি। কারণ আমেরিকান আদবকায়দা এতদিনে অনেকটা শিখে ফেলেছি। আমাদের সমস্যায় বাড়িয়ালা খুব দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন তিনি সত্যি চান আমাদেরকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে। কিন্তু আমেরিকান রুলস অনুযায়ী একবার লিজ সাইন করলে আমাদের যাই হোক না কেন ভাড়া দিতে আমরা বাধ্য। তাই এ ব্যাপারে ওনার কিছু করার নেই। আর রুলস না মানলে আমাদের নামে কোর্টে মামলা উঠবে, তখন আমাদের ভিসা স্ট্যাটাস বাতিল হয়ে যাবে। খুব ভয় পেয়ে যাই আমরা।

লিজ শেষ হতে এখনও ছয় মাস বাকি। খুব রাগ হয় শায়লা আপুর উপর আমাদের। আমরা ধরে নেই শায়লা আপুর বিয়ে, তাই উনি চলে যাচ্ছেন। ব্রুকিংসের সবাই ধরে নেয় আপুর বিয়ে। দেখা হলেই আপুকে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে, ছেলের পরিচয় জানতে চায়। আমি দিন রাত হিসাব করি, ক্রেডিট কার্ডে এপ্লাই করি। কার্ড পাই খুব অল্প টাকার।

মনির ভাই গ্রাজুয়েশন পার্টি দেয়। আমরা কাবাব আর ডিমের কারি নিয়ে যাই। মলি ভাবী একটা কেক বানিয়ে নিয়ে আসে। অনেক মজা করি আমরা। শায়লা আপুর বিয়ে নিয়ে খুব আলোচনা হয়। আমরা সবাই শায়লা আপুর সুখি দাম্পত্য জীবন কামনা করি। পার্টি শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে যায়। বাইরে এসে দেখি তুষারে ঢেকে গেছে সব। সাজ্জাদ কাঁপতে কাঁপতে গাড়ি পরিষ্কার করে। আমাদেরকে বাসায় পৌঁছে দেয়।

আমরা রোজ হেঁটে হেঁটে ডিপার্টমেন্ট যাই। ডিপার্টমেন্ট যেয়ে দেখি আমার মোজা ভিজে গেছে। বিকেলে আমি বাসায় ফিরি। পরদিন থেকে আমি দুটো করে জুতো নিয়ে যাই। ডিপার্টমেন্ট যেয়ে জুতো চেঞ্জ করি। নাসরিন আমাকে স্নোবুট না কেনার জন্য খুব বকে। আমি অনলাইনে অনেক খুঁজি। কোনটির দামই চল্লিশের নিচে নয়। আমি বাড়িভাড়া, বেতন হিসেব করি। স্নোবুট কিনতে সাহস পাই না। নাসরিন আমাকে গুডউইল থেকে চার ডলারের একটা বুট কিনতে বলে। গুডউইল হল আমেরিকার একটি দোকান। কারো যদি কোন কিছু আর ব্যবহার করতে ইচ্ছে না করে, অথচ সেটা এখনও ব্যবহারযোগ্য, সেটা সে গুডউইলে দান করে। গুডউইল সেটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে। বিশাল বড় দোকান। খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা সবকিছু। চট করে ধরা যায় না, এটা পুরনো জিনিষের দোকান। এখানে থালাবাসন কাপড়চোপড়, বিছানা বালিশ, ফার্নিচার, শো পিছ, গল্পের বই, মুভি সিডি সব পাওয়া যায়। গরীব মানুষেরা এখানে কেনাকাটা করে।

অন্যের ব্যবহার্য জিনিস, প্রথমে কিনতে খুব অস্বস্তি হয়। আমার চেয়ে এক সাইজ বড় এক জোড়া স্নোবুট কিনে ফেলি। কারণ এর থেকে আর ছোট সাইজ নেই। আমেরিকানদের পা অনেকটা হাতির পায়ের মত। নাসরিন বললো সমস্যা নেই, আস্তে আস্তে হাঁটবি, পা ঢাকা নিয়ে তো কথা। পরদিন আমি স্নোবুট পরে ডিপার্টমেন্ট যাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বেশী দূর এগোতে পারলাম না। জুতার সাইজ বড় হওয়ার কারণে পড়ে যাচ্ছিলাম। নাসরিন আমাকে হাত ধরে ধরে নিয়ে গেল। ফেরার সময় হাত ধরে ধরে নিয়ে আসল। এরপর আর কোনদিন ঐ বুট পরা হয়নি, নাসরিন মাঝে মাঝে শখ করে পরত।

শায়লা আপু চলে যাচ্ছে। আমি তার ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছি। যাবার সময় আপু আমাদেরকে বিপদে ফেলার জন্য খুব দুঃখ প্রকাশ করেন। উনি ফান্ড পাচ্ছেন না। তাই চাঁচার বাসায় ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাহলে বাসা ভাড়াটা বাঁচবে। আর মিনেসোটায় বাইরে কাজ করার সুযোগ আছে। আমার আর নাসরিনের খুব মন খারাপ হয়। আপুকে জড়িয়ে ধরে আমরা অনেক্ষন কাঁদি। আমরা আপুকে বাস স্টেশন পর্যন্ত দিয়ে আসি।

একদিন পর আপু ফোন করে জানায় আপু পৌঁছে গেছে। এরপর আপুকে আর কখনো ফোনে পাইনি।

কয়েকদিন পর মনির ভাই ও চলে যায়। হঠাৎ ব্রুকিংস টা খুব শূন্য হয়ে ওঠে।

সেমিস্টার ফাইনাল চলে আসে। আমি আর নাসরিন দুজনই ব্যস্ত। ডি এস পি পরীক্ষায় জ্যাক আমাকে জিজ্ঞেস করে; একটা প্রবলেম তার কাছে মনে হচ্ছে ভুল আছে। আমি বলি, ভুল নেই, সে চাইলে আমি তাকে সমাধানটি দেখাতে পারি। সে বলে, আমি কপি করা ভীষণ ঘৃণা করি।

আমাদের টার্ম ফাইনাল শেষ। আমি সেমিনারে এ পেয়েছি। সেমিনারের প্রফেসর আমাকে তার ল্যাবে জয়েন করতে বলেছেন। আমি টি এ কন্ট্রাক্ট বাতিল করে আর এ হিসেবে জয়েন করি।


প্রবাসে সিরিজের গল্পসমূহঃ

 পর্ব ১ঃ যাত্রাপথের গল্প
 পর্ব ২ঃ নতুন বাসা, ওরিয়েন্টেশন, রাস্তা হারানো
 পর্ব ৩ঃ পুলিশ আসা, রেজিস্ট্রেশন বিড়ম্বনা
 পর্ব ৪ঃ ডরমেটরির গল্প, প্রথম তুষারপাত
 পর্ব ৫ঃ ইন্টারন্যাশনাল নাইট, বাসা নিয়ে ঝামেলা, শায়লা আপুর চলে যাওয়া
 পর্ব ৬ঃ কামরানকে হাসপাতালে নেওয়া, টেকো সুদীপ আর ব্রিটিশ প্রফেসরের গল্প
 পর্ব ৭ঃ ল্যাব ও ফরাসী যুবকের হৃদয় ভাঙার গল্প
 পর্ব ৮ঃ সামার এসেছে, বেতন পাইনি, প্রথম বাসা ছেড়ে দিলাম
 পর্ব ৯ঃ সঙ্গীহীন জীবন, সুরিয়া মথুর গল্প, সামারের দিনলিপি, একা পথ চলা
 পর্ব ১০ঃ বিদেশী ভাষা শেখা ও আমেরিকান চাষাবাদের গল্প
 পর্ব ১১ঃ আমার বাইবেল শেখা
 পর্ব ১২ঃ সাজ্জাদের চলে যাওয়া, লিবিয়ান পরিবারের গল্প
 পর্ব ১৩ঃ মুহিত ভাইয়ের গল্প, আমার আগুন ধরিয়ে ফেলা
 পর্ব ১৪ঃ মসজিদ, ঈদ, ইয়ামিনী আসা, নতুন বাসা, আমেরিকান বিয়ে ও অরিগন যাবার গল্প
 পর্ব ১৫ঃ
 পর্ব ১৬ঃ
 পর্ব ১৭ঃ
 পর্ব ১৮ঃ
 পর্ব ১৯ঃ

লেখক পরিচিতিঃ

 জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ ক্যারোলিনা এ এন্ড টি স্টেট’ ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ‘PhD’ করছেন এবং তার গবেষণার বিষয় হল ‘Real time Object detection with Higher Accuracy’। jannatunজান্নাতুন নাহার তন্দ্রার স্কুল জীবন কেটেছে চুয়াডাঙ্গা শহরে, কলেজ জীবন হলিক্রস কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। এবং সেখান থেকেই ২০১০ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষে ২০১২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং ২০১৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা অবসরে লিখতে ভালবাসেন এবং সে অভ্যাস বশতই আমেরিকার গ্রাজুয়েট প্রোগামে একা একটি মেয়ে পড়তে আসার অভিজ্ঞতা (সাউথ ডাকোটা) একসময় তিনি লিখতে শুরু করেন। এবং তার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘প্রবাসে’ নামে ২০১৫ সালের ‘একুশে বই মেলায়’ তার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি কোন তথ্যমূলক বই নয় বরং বলা যায় এটি লেখিকার রোজকার ডায়েরী।