আমি গাড়ি চালাচ্ছি। ভালই চালাচ্ছি। তবে কার্বের সাথে একদিন ধাক্কা খেয়ে গাড়ির টেইল লাইট ভেঙে ফেলেছি। আশিক তার বাড়িতে রাতে আমাদেরকে দাওয়াত দিয়েছে। আশিককে আগে আড়ালে কিপটা আশিক ডাকা হতো। কিন্তু এখন আর ডাকা যাচ্ছে না। কারণ বউ আসার পর থেকে আশিক রোজই দাওয়াত দিচ্ছে। দাওয়াত খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। আজকেও আশিক দাওয়াত দিয়েছে। আমরা বিরক্ত হয়ে রওনা দিয়েছি। গাড়ি চালাচ্ছে নাসরিন। টেইল লাইট ভেঙে ফেলায় আমাকে চালাতে দিতে সাহস পাচ্ছে না। আমাদের রিয়ারভিউ মিররে পুলিশের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। এখানে পুলিশগুলো খুব ধুরন্দর। সবসময় গাড়ি নিয়ে পেট্রোল করে।  রাস্তায় ট্রাফিক দেখেও না দেখার ভান করে। কিন্তু সামান্য ভুল করলে আবার ক্যাক করে চেপে ধরে। সবচেয়ে বেশি ধরে হাইওয়েতে। হাইওয়েতে পুলিশের গাড়ি দেখা যায় না। লোকজন মনের সুখে স্পিড তোলে। আর ঝোপের আড়াল থেকে পুলিশ বেরিয়ে এসে ধরে ফেলে। আশিককেও একদিন ধরেছে। কিন্তু তার স্ত্রী গর্ভবতী থাকায় ছেড়ে দিয়েছে।

আমি আর নাসরিন কেউ গর্ভবতী নই। তাই আমাদেরকে সাবধানে চালাতে হচ্ছে। আমরা সাবধানেই চালাচ্ছি। তবুও পুলিশের গাড়ি কেন দেখা যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। আমাদের স্পিড লিমিট হেড লাইট সবকিছুই তো ঠিক আছে। নাসরিন বললো, আমাদেরকে পুলিশ ধরেছে। আমি বলছি, না তা কেন হবে! আমরা তো কোনো ভুল করিনি। পুলিশ নিশ্চয়ই অন্য কাউকে ধরতে যাচ্ছে। নাসরিন আমার কথা বিশ্বাস করেছে। পুলিশের গাড়ি উপেক্ষা করে, একমনে এখন সে গাড়ি চালাচ্ছে। প্রচণ্ড জোরে হর্ন খেয়ে নাসরিন গাড়ি থামিয়েছে। আমাকে বলছে, দেখতো কি হয়েছে।

পুলিশ বলে কথা, ওরা কেন নামবে! আমিই দরজা খুলে এগিয়ে গেলাম। বিনয়ের সাথে বললাম, পুলিশ ভাই কি হয়েছে? আমরা কি কোন ভুল করেছি? পুলিশটা প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, “গাড়িতে ঢোকো। এক্ষুনি ঢোকো বলছি। পকেট থেকে হাত বের করো। আর গাড়ির গ্লাস নামিয়ে কথা বলো”। টেইল লাইট কাজ না করায় পুলিশ আমাদের ধরেছে। তবে প্রথমবার ভুল হওয়ায় ছেড়ে দিয়েছে। ঘটনাটা আশিককে বলেছি আমরা। আশিক খুব হাসাহাসি করল আর বলল, আমেরিকাতে পুলিশে ধরলে সবসময় গাড়িতে থাকবে। পুলিশই তোমার কাছে আসবে। তুমি যদি গাড়ির দরজা খোলো অথবা হাত পকেটে রেখে কথা বলো, ও ভাববে, তোমার কাছে বন্দুক আছে। তুমি ওকে শ্যুট করবে। আমার কাছে সত্যিই বন্দুক ছিল কিনা আশিক তা আবার জানতে চাইল।

রুমা আপুর বাচ্চা হবে। পাঁচমাস চলছে। প্রেগন্যান্ট থাকায় রুমা আপুর চেহারায় আলগা লাবন্য এসেছে। রুমা আপু এখন প্রতিদিন বেবির গল্প শোনাচ্ছেন। জানো আজ বেবি নড়েছে। প্রচণ্ড জোরে লাথি দিয়েছে। আমরা কান পেতে বেবির নড়াচড়া বোঝার চেষ্টা করছি। একসময় আপুর যাবার সময় হল। ডিফেন্স শেষ, আজকেই রওনা দিবেন। ভাইয়া এসেছেন। ভাইয়া আমাদের জন্য চিংড়ি শুটকি, বাসমতী চাল ও আর অনেক কিছু এনেছেন।

নাসরিন একদিন রুমা আপুর দেওয়া শুটকি রান্না করল। শুঁটকির সুগন্ধি সুবাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। শুঁটকির সুবাস ছড়ানোর জন্য বাড়িয়ালা আমাদেরকে নোটিশ পাঠালেন। নোটিশে বলা হল কোন দুর্গন্ধযুক্ত খাবার রান্না করা যাবে না। নাসরিনের ধারণা নোটিশ; বাড়িয়ালা পাশের এপার্টমেন্টের বুড়ীর পরামর্শে পাঠিয়েছে। আমাদের পাশের এপার্টমেন্টে এক বুড়ী থাকে। সে প্রায়ই আমাদের পার্কিং লটের সাথে তার পার্কিং লট গুলিয়ে ফেলে। এ জন্য নাসরিন বেশ বিরক্ত তার উপর। তবে আমার ধারণা বুড়ী বেশ ভালো। একবার আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল। বুড়ী বললো, আমার বয়ফ্রেন্ড আসলে ওকে বলব। চার্জ ছাড়া তোমাদের গাড়ি ঠিক করে দিবে। এরকম খুনখুনে বুড়ীরও বয়ফ্রেন্ড আছে জেনে আমার বেশ মন খারাপ হল।

এর মাঝে ল্যাবের সবার জন্য আমি একদিন বাংলাদেশি খাবার রান্না করলাম। সবাই খুব চেটে পুটে খেল। ডক্টর হেলডার চেটে পুটে খেলেন ও একদিন আমাকে ডাকলেন। বললেন, তার বাড়িতে তিনি আমাকে ইনভাইট করে নিয়ে যেতে চান। তবে ইনভাইটের ধরণটা একটু আলাদা। আমি রান্নার উপকরণের তালিকা করব, উনি বাজার করে রাখবেন, আমাকে যেয়ে বাংলাদেশি খাবার রান্না করতে হবে। কারণ সেদিন আমার রান্না  বাংলাদেশি খাবার তার খুব ভাল লেগেছে। তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদেরকে  এখন তিনি বাংলাদেশি খাবার খাওয়াতে চান। বললাম, ইনভাইট করলে আমার বন্ধু নাসরিনকেও করতে হবে। উনি রাজি হলেন।

হেলডারের বাসায় আমি রান্না করছি। নাসরিন এখনও এসে পৌঁছায়নি। হেলডারের ছোট মেয়ের জামাই আমাকে সহযোগিতা করেছেন। সহযোগিতা করে খুব আনন্দ পাচ্ছেন। আমি যেই রান্নাই করছি, সেটিতেই গুবলেট পেকে যাচ্ছে। নাসরিন চলে এসেছে। বলছে, চিন্তা করিস না। বাংলাদেশি গুবলেট, এসব বলদ আমেরিকানরা ধরতে পারবে না। আমাদের রান্না শেষ হল। আমাদের গুবলেট রান্না খেয়ে হেলডারের পরিবার অমৃত বললো। হেলডারের মেজ মেয়ে আসতে পারেনি। তার জন্য গুবলেট রান্না পাঠিয়ে দেওয়া হল। আমাদেরকেও গুবলেট দেওয়া হচ্ছিল। আমরা বললাম, না না দরকার নেই।

নাসরিনের এখন টেরি নামের এক আমেরিকান বুড়ী মহিলার সাথে ভাব হয়েছে। প্রায়ই একটা গুবলেট বিরানি করে, সে টেরির বাড়ি যাচ্ছে। আমাকেও জোর করছে। এখানে বয়স্ক আমেরিকানরা অনেক নিঃসঙ্গ থাকে। নিঃসঙ্গতা দূর করতে তারা ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের বিভিন্ন ইভেন্টে দাওয়াত করে। তারপর নিঃসঙ্গতা কাটাতে আস্তে আস্তে খাতির করে। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের এখানে লাভ, বিপদে আপদে এসব আমেরিকানরা এদের সাহায্য করে। নাসরিনের সাথে আমি একদিন টেরির বাড়ি গিয়েছি। টেরি একটি মিনি স্কার্ট পরে আছে। টেরির বয়স ভালই। টেরিকে দেখে আমার নিজের বুড়ী দাদীর কথা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার দাদীই যেন স্কার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। টেরিকে গোপনে দাদী ডাকছি আমি। দাদী ডাকটা দেখি নাসরিনের খুব পছন্দ হয়েছে। সেও গোপনে টেরিকে দাদী ডাকছে। কিন্তু সামনে আসলেই, ও-ও-ও  টেরি বলে, খালাতো বোনের মত জড়িয়ে ধরছে। টেরি দাদী আমাদের সাথে অনেক ছবি তুলছে, ফেসবুকে আপলোড দিচ্ছে। টেরি দাদীর খাতির আমার ভাল লাগছে না। কারণ তার কুকুর লুসি শুধু আমাকে দেখলেই তেড়ে আসছে।

২০১৪, মে মাস এসে গেছে। আমি আর নাসরিন দেশে যাচ্ছি। আমেরিকান একটি মেয়ে, ক্যাট আমাদের রাইড দিচ্ছে। নাম ক্যাট হলেও ক্যাট দেখতে অনেকটা এলিফ্যান্টের মত। ক্যাট ভীষণ ছোট একটা জামা পরেছে। এত ছোট জামায় তার এলিফ্যান্ট স্বাস্থ্য বিশ্রী ভাবে বেরিয়ে আছে। স্বাস্থ্য কমানোর জন্য ক্যাট দিনরাত সুইমিং করছে। কিন্তু তাতেও তার পছন্দের ছেলেটি গলছে না। সে খুব মন খারাপ করে আমাদের সেই গল্প বলল। ক্যাট বেশ শক্তিশালী। আর সব লাগেজ নিমিষেই তুলে ফেলল। এত শক্তিমান মেয়েকে, ছেলেটি কেন অবহেলা করছে আমরা বুঝতে পারলাম না।

আমি আর নাসরিন প্লেনে একসাথে বসেছি। আমরা গল্প করছি। খুব মজা হচ্ছে। নাসরিন আমার সাথে বিবাহ প্রস্তুতি হিসেবে কিছু অশ্লীল গল্প করার চেষ্টা করছে। আমি শুনছি না এমন ভান করছি। আসলে কান খাড়া করেই শুনছি। অশ্লীল গল্প শুনতে ভাল লাগছে।

আমি আর নাসরিন শিকাগো থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। আমি দেশে পৌঁছেছি। বিয়ের পিড়িতে বসেছি। বিদায় পর্বে আমার মা খুব কাঁদছেন। আমি হাজার চেষ্টায়ও চোখে জল আনতে পারছিনা। জেট ল্যাগের কারণে ভীষণ ঘুম পাচ্ছে আমার।

মাসখানেক পর, দ্বিতীয়বার আমি দেশ ছাড়ছি। এয়ারপোর্টে বিদায় জানানো হচ্ছে। প্রথমবার দেশ ছাড়ার মত এবারোও প্রচণ্ড হম্বি তম্বি হচ্ছে। তবে হম্বি তম্বি করছেন আমার শ্বশুর। আমার বাবাও আছেন। তবে এবার উনি হম্বি তম্বি করছেন না। হম্বি তম্বি না করতে পেরে অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছেন। বাবার অসহায় চোখ দেখে আমার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু বাবা খুব ডিপ্লোম্যাটিক আচরণ করছেন। এমন ভাব করছেন যেন, এই মেয়েটি তার নিজের নয়। পাশের বাড়ির কাউকে বিদায় দিতে এসেছেন। বাবার মেয়ে না হতে পারায় খুব খারাপ লাগছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আসছে। কান্না থামাতে আমার শ্বশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বাবা দূর থেকে আমাকে দেখছেন। আমি খুব কাঁদছি। মনে মনে একটি গানও করছি। “আমি এখন বউ হয়েছি। বাবার মেয়ে নয়”।

আমি আমার হাসবেন্ডের সাথে আমেরিকা আসছি। টার্কি থেকে আমরা আলাদা হয়ে যাচ্ছি। আমার হাসবেন্ড আমাকে বিদায় দিচ্ছে। আর তার ব্যাকপ্যাক থেকে ঝুপ ঝুপ করে জিনিসপত্র ঝরে ঝরে পড়ছে। অধিক জিনিসপত্রের ভারে হাসবেন্ডের ব্যাকপ্যাক ছিঁড়ে গেছে। আমি আলাদা হবার আগে গুণধর  হাসবেন্ডের ব্যাগ সেলাই করছি। কালো ব্যাগ সাদা সুতা দিয়ে সেলাই করছি। আমার সেলাই সে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। আমাকে স্বামীসেবাপরায়ণ সতি নারী ভাবছে। আমিও হাসি মুখে সেবা সেবা ভাব করছি আসলে ভিতরে ভিতরে ভীষণ বিরক্ত লাগছে আমার। ব্যাগের কাপড় মোটা হওয়ায় হাতে বার বার সূচ ফুটছে। এয়ারপোর্টের অনেকেই সেই সেলাই দেখছে। তবে তারা স্বামীর মত মুগ্ধ কিনা বুঝতে পারছি না।

আমি ব্রুকিংস পৌঁছেছি। বাসায় কোন খাবার নেই। চানাচুর দিয়ে ভাত মাখিয়ে খাচ্ছি। খিদে পেটে অমৃতের মত মনে হচ্ছে।

ল্যাবের সবকিছু অন্যরকম মনে হচ্ছে আমার। অনেকেই গ্রাজুয়েশন করে চলে গেছে। অনেক নতুন ছেলে মেয়ে এসেছে। একজন ব্রাজিল থেকে এসেছে। সে এখন  সুদীপের জায়গাটায় বসছে। ছেলেটিকে দেখতে ফুটবলার পেলের মত লাগছে। পেলেই তার দাদা কিনা বুঝতে পারছি না। আর একটি নতুন ছেলেকে দেখছি জর্ডান। সে জ্যাকের জায়গাটায় বসছে। জর্ডানকে নিয়ে সবাই খুব হাসাহাসি করছে। হাসির কারণ, জর্ডান যখন সবাইকে অফিসিয়াল ইমেইল করে, ইমেইল এর নিচে একটা করে মনিষীদের উক্তি লেখে। জর্ডানকে সবাই আড়ালে মনিষী ডাকছে। লাঞ্চ রুমে তাকে দেখি খাবার সময়ও সে অডিও লেকচার শুনছে। সেখানে মনিষীদের বাণী শোনানো হচ্ছে। জর্ডানের সাথে অনেক কথা হল তবে সে মনিষীদের বিষয়ে নয়। কালার ব্লাইন্ড হওয়ায় জর্ডান ইমেজের রঙ বুঝতে পারে না। একটা ফিরোজা রঙ দেখিয়ে বলল, এটা ম্যাজেন্টা কিনা দেখোতো?

রায়ানের জায়গায় এখন আর একটি এয়ারফোর্সের ছেলে এসেছে, সাউথ কোরিয়া থেকে। ছেলেটির সাথে পরিচিত হলাম। ছেলেটি বললো, তার নাম জনসন হং, তবে এটি তার আসল নাম নয়। জনসনের আসল নামটার উচ্চারণ খুব কঠিন। এত কঠিন, যে লিখতেও পারছিনা। সে বললো, শুধু সেই নয়, সাউথ কোরিয়ার সবাই, আমেরিকা আসলে এফিডেভিট করে নাম বদলে, আমেরিকান নাম নিয়ে ফেলে। আমেরিকান নাম নিলে আমেরিকানদের ডাকতে সুবিধা হয়। জনসন আমাকে জিজ্ঞেস করল আমার নামটিও আসল কিনা!

অমেয়া গ্রাজুয়েশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমিও নিচ্ছি। আমরা চলে যাবার পর আমাদের জায়গায় কে বসবে বুঝতে পারছি না। সুমন বলছে, সে আমার জায়গায় বসবে। বসার কারণ, এখান থেকে ফেসবুক খুললে, অন্যরা  সরাসরি দেখতে পায় না । প্রফেসরের পায়ের শব্দ পেলে হেলেদুলে বন্ধ করা যায়। ডক্টর সবিতা চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। ল্যারি ফ্যাকাল্টি হয়ে গেছে। তবে সে সবিতার রুমে নয় আলাদা রুমে বসছে। আমি প্রতিদিন অসংখ্য ম্যাসেজ পাচ্ছি। অনেক বাংলাদেশি নতুন ছেলেমেয়ে আসছে। তারা বাসা খোঁজার ব্যাপারে সাহায্য চাচ্ছে। আমাদের বাসাটা নিতে চাচ্ছে। কিন্তু লিজ শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে বাসাটা আমরা দিতে পারছিনা। আমি নাসরিন আর ইয়ামিনী সামারের পর আলাদা হয়ে যাচ্ছি। আলাদা হবার কারণে বাসা ছেড়ে দিচ্ছি, লিজ এক্সটেন্ড করছিনা।

নাসরিন দেশ থেকে এখনও ফেরেনি। সামারের পর ফিরবে। নাসরিন না থাকায় ব্রুকিংসটা খুব অচেনা লাগছে। মলি ভাবী, কান্তা আপুরা ব্রুকিংস ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আশিকের বউ তাদের দাওয়াত করে খাওয়াচ্ছে। তবে খুব বেশি আইটেম, সে রান্না করতে পারছে না। কারণ  আশিকের পাকনা ছেলেটা তাকে জ্বালিয়ে ভাজা ভাজা করছে।

আমাদের গাড়িটা বেচে দিয়েছি। গাড়ি না থাকায় আমি এখন হাঁটছি। আমার সেই চির চেনা রাস্তায় হাঁটছি।

আমার মাস্টার্স এর ডিফেন্স শেষ হয়েছে। নর্থ ক্যারোলিনায় পি এইচ ডিতে এডমিশন হয়েছে। আমি নর্থ ক্যারোলিনা যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রস্তুতি হিসেবে আমি শুধু হাঁটছিই। সেই প্রথম দিনগুলোর মত হাঁটছি। অচেনা দেশের চেনা শহরে হাঁটছি। রেল লাইনের ধারে হাঁটছি। হাঁটছি আর হাঁটছি। হেঁটে হেঁটে মন বিষণ্ন করছি।

আমি বাসা ছেড়ে দিচ্ছি। বাসা পরিষ্কার করছি। আমার রেখে যাওয়া সব স্মৃতি চিহ্ন ঘসে ঘসে তুলছি। রাত ৩টা বাজে। আমি ঘসে তোলা শেষ স্মৃতিগুলো বাইরে ডাস্টবিনে যেয়ে ফেললাম আর ভূতের ভয়ে কিছুটা কেঁপে উঠলাম। হাতে বেশি সময় নেই। ৪টা বাজে রওনা দিয়েছি। অমেয়া আমাকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিচ্ছে। সব চেনা পথ ফেলে আমাদের গাড়ি ছুটছে। আমরাও ছুটছি। অচেনা দেশের চেনা শহরেকে ফেলে ছুটছি। অন্ধকারে চেনা সব পথগুলো অচেনা লাগছে আমার, প্রথমদিন এই শহরটাতে পা রাখার মতই ঘোলাটে লাগছে।

প্লেন ছেড়ে দিচ্ছে। ডাকোটার প্রেইরিল্যান্ডকে বিদায় জানাচ্ছি। তার তুষারপাত, ঊর্বশী গাছ সবাইকে বিদায় জানাচ্ছি। সব কিছু বিন্দু বিন্দু হয়ে আসছে। বিন্দু বিন্দু আমার চোখেও জমা হচ্ছে।

নর্থ ক্যারলিনা পৌঁছে গেছি। বিখ্যাত কবি ও গল্পকার ও হেনরির জন্মশহর গ্রিন্সবোরোতে। এই শহরে এসে নিজেকে ভীষণ ফর্সা মনে হচ্ছে। চারদিকে ভয়ঙ্কর মোটা মোটা কালো আমেরিকানদের দেখছি। আমেরিকার ব্লাক অধ্যুষিত সিটিতে এসে পড়েছি আমি। একজন লম্বু বাংলাদেশি  ব্লাক আমাকে নিতে এসেছেন। আমি হাঁটছি, তার সাথেই হাঁটছি। তার গেঞ্জির খুট ধরে হাঁটছি।

আমরা এখন টিলার মত উঁচুনিচু রাস্তায় হাঁটছি। রাস্তাটা এঁকেবেঁকে মিশেছে হেনড্রিক্স স্ট্রীটে। এখানেও বাচ্চাদের একটা স্কুল আছে। স্কুল থেকে ঢাকের আওয়াজ আসছে। ওদের সুশৃঙ্খল প্যারেডের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে হেনড্রিক্স স্ট্রীটের ফুটওভার ব্রিজটার উপর  এসে দাঁড়িয়েছি। ব্রিজের দুপাশে সুশৃঙ্খল ঘন বন। সন্ধ্যে নেমে এসেছে। এখানেও রেল লাইন আছে। ব্রিজের নীচ দিয়ে রেল ছুটছে। আমি ডাকোটার মত রেলের বগি গুনছি। ঝিক ঝিক শব্দ শুনছি। রেললাইনের শেষ পর্যন্ত তাকিয়ে আছি।

আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে ও হেনরির ‘হার্ড টু ফরগেট’ কবিতা।

I’m thinking to-night of the old farm, Ned,
And my heart is heavy and sad
As I think of the days that by have fled
Since I was a little lad.

There rises before me each spot I know
Of the old home in the dell,
The fields, and woods, and meadows below
That memory holds so well.

-সমাপ্ত-

 

 


প্রবাসে সিরিজের গল্পসমূহঃ

 পর্ব ১ঃ যাত্রাপথের গল্প
 পর্ব ২ঃ নতুন বাসা, ওরিয়েন্টেশন, রাস্তা হারানো
 পর্ব ৩ঃ পুলিশ আসা, রেজিস্ট্রেশন বিড়ম্বনা
 পর্ব ৪ঃ ডরমেটরির গল্প, প্রথম তুষারপাত
 পর্ব ৫ঃ ইন্টারন্যাশনাল নাইট, বাসা নিয়ে ঝামেলা, শায়লা আপুর চলে যাওয়া
 পর্ব ৬ঃ কামরানকে হাসপাতালে নেওয়া, টেকো সুদীপ আর ব্রিটিশ প্রফেসরের গল্প
 পর্ব ৭ঃ ল্যাব ও ফরাসী যুবকের হৃদয় ভাঙার গল্প।
 পর্ব ৮ঃ সামার এসেছে, বেতন পাইনি, প্রথম বাসা ছেড়ে দিলাম
 পর্ব ৯ঃ সঙ্গীহীন জীবন, সুরিয়া মথুর গল্প, সামারের দিনলিপি, একা পথ চলা
 পর্ব ১০ঃ বিদেশী ভাষা শেখা ও আমেরিকান চাষাবাদের গল্প
 পর্ব ১১ঃ আমার বাইবেল শেখা
 পর্ব ১২ঃ সাজ্জাদের চলে যাওয়া, লিবিয়ান পরিবারের গল্প
 পর্ব ১৩ঃ মুহিত ভাইয়ের গল্প, আমার আগুন ধরিয়ে ফেলা
 পর্ব ১৪ঃ মসজিদ, ঈদ, ইয়ামিনী আসা, নতুন বাসা, আমেরিকান বিয়ে ও অরিগন যাবার গল্প
 পর্ব ১৫ঃ অরিগন ভ্রমন, শুরুর গল্প।
 পর্ব ১৬ঃ অরিগনের গল্প, ক্যানন বিচ, লাল টমেটো
 পর্ব ১৭ঃ অরিগন ভ্রমণ-ফেরা, নাসরিনের দেশ থেকে ফেরা, লার্নার্স পারমিট, ডান চোখ নষ্ট হওয়া, গাড়ি কেনা ও ড্রাইভিং শেখা
 পর্ব ১৮ঃ ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া, রুমা আপুর আগমন
 পর্ব ১৯ঃ

লেখক পরিচিতিঃ

 জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ ক্যারোলিনা এ এন্ড টি স্টেট’ ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ‘PhD’ করছেন এবং তার গবেষণার বিষয় হল ‘Real time Object detection with Higher Accuracy’। jannatunজান্নাতুন নাহার তন্দ্রার স্কুল জীবন কেটেছে চুয়াডাঙ্গা শহরে, কলেজ জীবন হলিক্রস কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। এবং সেখান থেকেই ২০১০ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষে ২০১২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং ২০১৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা অবসরে লিখতে ভালবাসেন এবং সে অভ্যাস বশতই আমেরিকার গ্রাজুয়েট প্রোগামে একা একটি মেয়ে পড়তে আসার অভিজ্ঞতা (সাউথ ডাকোটা) একসময় তিনি লিখতে শুরু করেন। এবং তার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘প্রবাসে’ নামে ২০১৫ সালের ‘একুশে বই মেলায়’ তার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি কোন তথ্যমূলক বই নয় বরং বলা যায় এটি লেখিকার রোজকার ডায়েরী।