দুটি আমেরিকান ছেলে আমাদের ফায়ার এলার্ম খুলতে সাহায্য করল। আগুন নিভলে ওরা চলে গেল। আমি তখন কাঁদছি। কিছুটা ভয়ে বাকিটা লজ্জায়। নিজের দায়িত্ব জ্ঞানহীনতায়। সুরিয়া খুব ভাল মেয়ে ছিল। তার বাসায় এরকম একটি কাণ্ড ঘটিয়েছি। তবু সে কিছুই বললো না। তবে আগুন নিভলে পাতিল সরিয়ে দেখি কার্পেট পুড়েছে। টাইলসও পুড়েছে। এই পোড়াপুড়ির কারণে পরে আমাকে ৪০০ ডলার জরিমানা গুনতে হল।

এর মাঝে একদিন মসজিদে গেলাম। মসজিদের সামনে লেখা ইসলামিক কমিউনিটি সেন্টার। মসজিদে কোন মিনার নেই। কোন আজানও শোনা যায় না। আজান মানে প্রার্থনার আহবান। আজান, একরকম জীবন্ত ঘড়িও বলা যায়। অমুসলিম অনেককেও দেখেছি আজান শুনে সময় আন্দাজ করে। মুসলিমরা এখানে সফটওয়্যারে আজান শুনত। অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ দিয়ে দিলে সময় মতো আজান হয়। অনেকে মোবাইলে সেট করে রাখত। আর হঠাৎ সেটি বেজে ঊঠলে অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি বন্ধ করতো। মসজিদে মহিলা পুরুষ উভয়ের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা। তবে প্রবেশের, ওজুর জায়গা আলাদা। কেঊ কাঊকে দেখার সুযোগ নেই। নামাজ পড়তে হবে একই ঘরে তবে ভারী পর্দা দিয়ে আলাদা করা। অনেক আরব মহিলারা সেখানে ছিল। মলি ভাবী নুশেরাকে নিয়ে নামাজে এসেছে। নুশেরা লক্ষ্মী মেয়ের মতো আমরা যা করছি তাই করার চেষ্টা করছে। কিন্তু অন্য বাচ্চারা নুশেরার মতো নয়। তাদের কেঊ কেঊ  মায়ের ঘাড়ে উঠে বসে আছে। একটি বাচ্চাকে দেখি চুল ধরে তার মাকে সিজদা থেকে টেনে তুলছে। খুতবার সময় ইমাম সাহেব কি বললেন ঠিক মতো শোনা গেলো না। বাচ্চাগুলোর কান্নাকাটি  দাপাদাপির শব্দই বেশী শোনা গেল। মসজিদে যেয়ে আমার বেশ ভালো লাগলো কিন্তু আর যেতে পারলাম না। প্রতি শুক্রবার দুপুর বেলা আমার ক্লাস ছিল আর হুট করে বেরিয়ে গেলে খারাপ দেখায়। দেয়ালে একটা চার্ট ছিল, কোথায় যাচ্ছি লিখতে হবে। সেখানে প্রেয়ার  কথাটা লিখতে কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছিল।

আমাদের অরিগন যাওয়া একটু পিছিয়েছে। আমি ফ্লাইটের টিকেট বদল করলাম। ঈদের পর প্রোগ্রাম। নিজের ইচ্ছার চেয়ে বেশি বাবা–মায়ের ইচ্ছাতে আমার অরিগন যাওয়া। আমার বাবা–মায়ের ধারণা নাসরিনের বিয়ে হওয়াতে আমি একটু মানসিক অবসাদে ভুগছি। ঘোরাঘুরি করলে নিশ্চয়ই অবসাদ কেটে যাবে।

এখন আমেরিকায় বেশ ঝড় হচ্ছে। আমাদের এখানে একদিন টর্নেডো ওয়ার্নিং দিল। আমি টর্নেডো ওয়ার্নিঙের মধ্যে হেঁটে বাড়ি যাব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সুদীপ বললো কি করছ? বললাম বাড়ি যাচ্ছি। হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাব আর যেতে যেতে টর্নেডো দেখব।

আমরা ল্যাবের জানালা থেকে টর্নেডো দেখছি। সুদীপ বলেছে, টর্নেডো হলে সেফটি বাংকারে যেতে হয়। প্রত্যেক ইউনিভার্সিটিতে সেফটি বাংকার থাকে। আমরা সেফটি বাংকারে যাইনি। কারণ এটি ছোট খাট টর্নেডো। তবে এই ছোট খাট টর্নেডোয় দুপুরেই চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে। রাস্তা হাঁটু পানিতে ভর্তি হয়ে গেছে। তবে পরদিন দেখি হাঁটু পানি আর নেই, রাস্তাঘাট শুকিয়ে গেছে । এর মাঝে একদিন বৃষ্টিতে ভিজেও ফেলেছি  কিন্তু শীতে কাঁপুনি ধরে গেছে। ফ্রাঙ্ক বলল, বৃষ্টিতে ভিজেছো! রাইড চাইলেই পারতে। বললাম, ইচ্ছে করে ভিজেছি, বৃষ্টি ভালবাসি তবে আমেরিকান ঠাণ্ডা বৃষ্টি নয়। আমাদের দেশের বৃষ্টি খুব সুন্দর। বৃষ্টি আবার সুন্দর হবার কি আছে ফ্রাঙ্ককে বোঝাতে পারলাম না। এই নিয়ে ওরা খুব হাসাহাসি করল। কেউ কেউ বললো, ইজ ইট কালারফুল?

রোজা শেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার ঈদ এসেছে। তবে আমার কাছে নয়। আমার কাছে ভীষণ নিরিমিশে। নাসরিন নেই, সাজ্জাদ নেই। আমার কিছু করারও নেই। ডিপার্টমেন্ট গেলাম। আর সব দিনের  মতো কাজকর্ম করলাম। ভেবেছিলাম কোথাও যাবনা। কিন্তু ভাবীদের কারণে আর সেটি হল না। হলুদ একটি শাড়ী পরলাম। আমেরিকা আসার আগে আম্মু কিনে দিয়েছিলো। পরিনি এর আগে। সেটিকেই এখন ঈদের শাড়ী বলা যায়। এখানে অনেকেই এই কাজটা করে। দেশ থেকে আসার সময় অনেক কাপড় চোপড় নিয়ে আসে। কিন্তু সেগুলো কাউকে দেখায় না, লুকিয়ে রাখে। তারপর কোন উৎসব এলে একটি একটি করে বের করে পরে। যেন সেই উৎসব উপলক্ষেই সেটি কেনা। এই পদ্ধতিতে দুই বছর আগের একটি জামা তারা  ঈদের  জামা মনে করে পরে।

রায়হান ভাই এসে আমাকে নিয়ে গেলো। ওনার বাসায় দুপুরে খেয়ে বিকেলে ইফতেখার ভাইয়ের বাসায় গেলাম। ভালই লাগছিলো। ভাইয়ের মেয়ে রামিসার সাথে খেলছিলাম। বড়দের সাথে ঠিক কি আলাপ করব বুঝতে পারছিলাম না। রামিসা সারাদিন কি কি করেছে আমাকে বললো। তারা আজ সারাদিন স্ট্র বেরি তুলেছে। তার ধারণা স্ট্র বেরি তোলায় এবারের ঈদটি খুব মজার হয়েছে। এখানে ঈদে নিজেদের মধ্যে দাওয়াত খাওয়া ছাড়া আর করার কিছু নেই। তাই ঈদকে স্মরণীয় করতে অনেকেই স্ট্র বেরি তুলতে যায়। রোদের মধ্যে ঝুড়ি ভরে স্ট্র বেরি তুলে তারা ঈদ পালন করে।

খুব আড্ডা হল। ভাবীর রান্না খুব চমৎকার। ভাবী আমার দেখা সেরা রূপসীদের মধ্যে একজন। ভাবী মাথায় হেজাব পরেন। হেজাবের কারণে তার রূপ যেন আরও বেড়ে যায়। ভাবীর রূপের ছায়া রামিসার উপর পুরোটায় পড়েছে। মলি ভাবী রামিসাকে ঈদে একটি সিন্ড্রেলা ড্রেস দিয়েছেন। সেটি সে এখনই পরবে। কিন্তু ঝোল লাগানোর ভয়ে তার মা তাকে কিছুতেই পরতে দিতে চায় না। রামিসা আমার পিছনে ঘুর ঘুর করছে, তার ধারণা ড্রেসটি পরার ব্যাপারে আমি তাকে সাহায্য করতে পারি। তার মাকে পটাতে পারি। আমরা দুজন খুব কৌশল করছিলাম। কৌশল করে অবশেষে আমরা ভাবীকে পটিয়ে ফেললাম। আর এই পটানোর সফলতায়  রামিসার সাথে আমার খুব ভাব হয়ে গেল।

রাতে শুভ আমাকে বাসায় পৌঁছে দিল। এখানকার ইন্টারন্যাশনাল নাইটের মারামারির নায়ক ছিল সে। এই নায়ক হবার কারণে অধিকাংশ সাধারণ বাঙালীদের সাথে শুভ মেশে না। প্রোগ্রামেও যায় না। শুভ আন্ডারগ্রেড  দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। মারামারি করলেও শুভ  আমাদের সবার কাছে খুব আদরের। কিন্তু সে এতটাই  রগচটা; কেঊ তাকে ভয়ে  বলেও না,  যে সে  কতটা আদরের। শুভর জন্ম দুবাইয়ে। ওখানেই সে বড় হয়েছে। বাংলা বলে, তবে খুব পরিষ্কার  ভাবে বলতে  পারে না। আমাকে সবসময় টন্ড্রা আপু বলে।

আমাদের ল্যাবে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। ওজন কমানোর প্রতিযোগিতা। এন্ট্রি ফি ১০ ডলার। প্রতিযোগিতার আকর্ষণ হচ্ছে যে সবচেয়ে বেশি ওজন কমিয়ে, পাটকাঠি হতে পারবে সে সবার টাকাটা পাবে। পাটকাঠি হতে ও এতোগুলো টাকা পেতে প্রতিযোগিতায় আমিও নাম লেখালাম। প্রতি সপ্তায় আমাদের ওজন নেওয়া হচ্ছে। ওজন নেবার জন্য আমাদেরকে ওজন নেবার মেশিনে জুতা খুলে উঠতে হবে। ডক্টর হেলডার বলছেন, লেডিস ফার্স্ট। কিন্তু আমি কিছুতেই উঠছিনা। কারণ আমি  সেদিন ভুলে দু পায়ে দু রঙের  মোজা পরে এসেছি।

আমাদের ওজন কমানোর খেলা শেষ  হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ওজন বাড়ানোর কারণে  আমাকে অতিরিক্ত ১০ ডলার জরিমানা  করা হয়েছে।

আমি বাসা খুঁজে পেয়েছি। সুরিয়ার পাশের বিল্ডিং। বাসা খোঁজার সময় প্রোপার্টি ম্যানেজার মহিলা আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে চাইলেন। আমি বললাম দরকার নেই। আমিতো পাশের বিল্ডিংটায় থাকি। ম্যানেজারকে আমি বিল্ডিং দেখালাম, এপার্টমেন্ট নাম্বার বললাম। কিন্তু কেন জানি সে  অবাক হল। বাসায় এসে সুরিয়াকে বললাম, জানো আমার নতুন বাসার ম্যানেজার এতো ভালো। এই এই হয়েছে। প্রচণ্ড রেগে সুরিয়া বললো, তুমি তো সর্বনাশ করেছ তুমি কী জানো না এই বিল্ডিংটাও একি মালিকের । কতবার করে বলেছি তুমি এখানে থাকো ম্যানেজার যেনো না জানে। আর তুমি সেটি স্বয়ং ম্যানেজারকে যেয়ে বলে দিয়েছ। এখন ম্যানেজারতো আমাকে বের করে দিবে এখান থেকে। আমি দুঃখিত বলে বললাম, দেখো আমি যেদিন সিকিউরিটি মানি  দিতে যাব, ম্যানেজারকে বলবো, আমি আসলে ওখানে থাকি না।  জায়গা না পাওয়ায় দুদিন ছিলাম। দুদিনে উনি নিশ্চয়ই কিছু মনে করবেন না। ‘আর ম্যানেজার যেনো না জানে ব্যাপারটা’ আমি সত্যি  ভুলে গিয়েছিলাম।

সুরিয়াকে ঠাণ্ডা করতে আমি পরদিন চেক দেওয়ার সময় বর্তমান ঠিকানায় রুমা আপুর বাসার ঠিকানা দিলাম  আর বললাম, তোমাকে সেদিন যেটা বলেছিলাম সেখানে আমি মাত্র  ২ দিন  ছিলাম আর ……। ভদ্র মহিলা আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করেননি তবু আমি হড়বড় করে এত কথা কেন বলছি তিনি হয়ত বুঝলেন না। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি যখন নতুন বাসার লিজ সাইন করেছিলাম। আমাকে বিশাল এক পাতা প্রশ্নের উত্তর দিতে হল। অধিকাংশই খুব অদ্ভুত এবং অসম্মানজনক প্রশ্ন। যেমন তুমি কি পতিতা – হ্যাঁ বা না। তুমি কি ড্রাগ ডিলিং কর? এযাবৎ কি কি অপরাধ করেছ? পুলিশের কাছে ক’বার ধরা পড়েছ? কি সেক্স পছন্দ তোমার? অপজিট না সিমিলার?

নাসরিনকে লিখলাম বাসা পেয়েছি। ক্যাম্পাস থেকে কতদূরে জিজ্ঞেস করল। বললাম পনের মিনিট। আসলে আমি হাঁটলে বাইশ মিনিট। নাসরিনে হাঁটলে আঠাশ মিনিট। নাসরিন যদি রাগারাগি করে এই ভয়ে কমিয়ে বললাম। আসলে বাসা আমি অনেক খুঁজেছি। কিন্তু এপার্টমেন্ট পাওয়া বেশ দুষ্কর। কাছাকাছি দূরত্বের সিঙ্গেল হাঊজ অনেক আছে। তবে বিল বেশী, নিরাপত্তার ভয়, রুমমেটও পাওয়া যায় না। তবে এসব নাসরিনকে বিশ্বাস করানো কঠিন। নাসরিন বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিল বলে আমাকে বেশী ঘাটালো না। আর আমি রুমমেট খুঁজে পাওয়াতে সে বেশ খুশি। রুমমেটের নাম ইয়ামিনী, ‘ফলে’ আসবে। এই মেয়েকে রুমমেট হিসেবে পেতে যেয়ে যে আমার কী পরিমাণ যন্ত্রণা পেতে হলো সেটি লিখলে কয়েক দিস্তা কাগজ ফুরোবে। প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় সে আমাকে ইমেইল করত রুমের ছবি পাঠাও, কিচেনের ছবি, কমোডের ছবি। বাড়িয়ালাকে যেয়ে বল ভাড়া কমানো যায় কিনা। ইয়ামিনীর প্রতি সুরিয়াও বিরক্ত হয়ে গেল। সে আমাকে যে ইমেইল পাঠায়, সুরিয়াকেও পাঠায়। তারপর জাজ করে কোন উত্তরটি সঠিক।

আমার প্রফেসর হেলডারের ছেলের বিয়ে হচ্ছে। আমেরিকান বিয়ে। আমি প্রচণ্ড আনন্দ নিয়ে বিয়েতে এসে ভয়ে চুপসে গেছি। কারণ এখানে বরবধূকে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে জড়িয়ে ধরছে। চুমু দিচ্ছে। ধীরে ধীরে আমার পালা আসছে। আমি কি করব বুঝতে পারছিনা। আমি হেলডারকে আড়ালে ডেকে বললাম, তোমার ছেলে-ছেলের বউকে চুমু না দিলে, জড়িয়ে না ধরলে তারা কি খুব রাগ করবে। হেলডার ব্যাপারটা বুঝলেন। বললেন, না, তা কেন হবে। তুমি হ্যান্ডশেক করলেও হবে। আমি শুধু হ্যান্ডশেক করলাম।  বিয়েতে খুব আয়োজন করে আমাদের বসানো হয়েছে। খাবারের পাশেই আমরা বসেছি।  খাবারের টেবিলে ফুলকপি, ব্রকলি, গাঁজর কুটে রেখে দিয়েছে। মনে হচ্ছে এখনি কেউ এসে রান্না চাপাবে। আমাদেরকে খাবার দেওয়া হয়েছে। বিয়ে বাড়ির ভোজ খাচ্ছি আমরা। পুঁইশাক মাখন দিয়ে কচলে রেখেছে।গরু সিদ্ধ, পাউরুটি,  কেক আর কুটে রাখা কাঁচা ফুলকপি, ব্রকলি, গাজর। কাঁচা ফুলকপি খেয়ে আমার প্রায় বমি এসে যাচ্ছে কিন্তু আমার সামনে প্রফেসর এরন আর তার বউ বসেছে। তারা একটু পর পর নাইস ফুড বলছে। নাইস ফুড আমাকেও বলতে হচ্ছে আর বার বার নাইস ফুড বলতে যেয়ে আমি বমি গিলে ফেলছি।

অগাস্টের ১৩ তারিখ নতুন বাসায় উঠলাম। সুরিয়ার পাশের বিল্ডিং। ২ মিনিটের দূরত্ব। কাউকে আর ডাকলাম না। আমি আর সুরিয়াই  টানাটানি করলাম। ভয়াবহ পরিমাণ কষ্ট হল সেদিন। রাত ১টায় টানাটানি শেষ হলে সুরিয়া চলে গেল। আমার আবার সেই প্রথমদিনের মত লাগছিল। এলোমেলো ঘর, একা আমি আর সাথে কিছুটা ভয়। নতুন বাসা গুছিয়ে ফেলেছি। বাসাটি খুব চমৎকার। আর বেছে বেছে সবচেয়ে চমৎকার রুমটি আমিই নিয়েছি। জানালার পর্দা সরালেই বাসার সামনেটা দেখা যায়। সবুজ ঘাস, ছবির মত আকা ঘরবাড়ি। এমনিতে এই নেইবারহুডটা আমার খুব পছন্দ। খুব ফাঁকা ফাঁকা বসতি। পাশে স্কুল। একটা রেল লাইন আছে। মাঝে মাঝেই ট্রেনের ঝিক ঝিক শোনা যায়। যখন ট্রেন যেতো আমি দাঁড়িয়ে পড়তাম, বগি গুনতাম, ঝিক ঝিক শব্দ  শুনতাম। রেললাইনের শেষ পর্যন্ত তাকিয়ে থাকতাম।

দেশে থাকলে এসব ছেলে মানুষী কখনই  করতাম না  হয়ত। সবাই আমাকে  পাগল ভাবত। এখানে এসব নিয়ে কেউ ভাবে না। এটা অনেকটা পাগলেরই দেশ। তাই নতুন পাগল কারো নজরে পড়ে না। আমি একদিন হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটি কুকুর আমাকে তাড়া করল। মনে হচ্ছিল এক্ষুনি খামচি দিয়ে রানের গোশত তুলে নেবে আর আমি মারা যাব। আমি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। আমাকে মৃত্যু থেকে বাঁচালো এক বুড়ো  আমেরিকান। কুকুরটিকে ডাক দিতেই সে আমার গোশত না খেয়ে চলে গেল। বুড়ো আমেরিকান বললো, আমি দুঃখিত। আমরা জনিকে ট্রেইনিং দিচ্ছি। ভয়ের কিছু নেই। সি ইজ লাভলি। তবে জনি কিছু করলে তুমি মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ পেতে। আমি হাঁ হয়ে বুড়োর কথা শুনলাম। মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ সত্ত্বেও ভুলেও ও রাস্তা আর  মাড়ালাম না।

ক্যাম্পাসে যাবার জন্য সবচেয়ে নির্জন রাস্তাটি আমি খুঁজে বের করেছি। ভীষণ নির্জন। মাঝে মাঝে দু একটি গাড়ি ‘সা’ করে চলে যায়। আমাকে দেখার সময় তাদের নেই। নির্জন রাস্তায় আমি একা একা গান গাইতাম।মনে মনে  কবিতা লিখতাম। গল্প করতাম। খুব রাগ হলে ঝগড়া করতাম। রিসার্চের কোন কাজে ঝামেলা হলে আমি এই রাস্তায়ই ভাবতাম,  আচ্ছা এটা……এরপর  সেটা ……। হুম তাহলে তো পরের স্টেপে এটিই হবে। আমার এই অনুর্বর মস্তিষ্ক সবসময় সমাধান পেত না। তবে এই রাস্তা, আমার একা একা পথ চলা মাথা খুলে দিত অনেক সময়। অনেক সময় দিত না। তবুও আমার ভাল লাগত। এই হাঁটাহাঁটির সময় আমার মাঝে মাঝে কাঠ বিড়ালীদের সাথে দেখা হত। ওদের জীবন নিয়ে অনেক ভাবনা আসত মনে। মাঝে মাঝে হিংসে হত। আহা একটা কাঠ বিড়ালীর জীবন হলে বেশ হত। কাঠ বিড়ালী হলে খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠতাম। সূর্য স্নান সেরে খাবারের সন্ধানে বেরোতাম। পোকামাকড় কিছু না জুটলে কচি পাতা খেতাম। তারপর দিনভর পাতার আড়ালে লুকোচুরি খেলতাম। এই হাঁটাহাঁটির সময় আমার সবচাইতে বেশি ইচ্ছে করেছে পাখি হতে। আমি হাঁটতাম আর পাখি দেখতাম। যদিও ওরা আমাকে দেখলেই ছুটে পালাতো। পাখি হলে বেশ হত।সপ্তাহে একদিন দীর্ঘ ভ্রমণ করতাম। ভাইবোন দুটোকে চুমু দিয়েই ছুটতাম। আমার ডানার সাথে ওরা বেঁধে দিত চিঠি। সেই চিঠির মিষ্টি ঘ্রাণে আমার দীর্ঘ ভ্রমণ ক্লান্তি কেটে যেত। এখানে পাখি দেখলেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম আমি। বাংলাদেশের পাখিদের সাথে মিলাবার চেষ্টা করতাম। শীতকালে তুষারপাতের সময় এখানে যখন কোন পাখি দেখা যেত না  আমার মনে হত ওরা নিশ্চয়ই বাংলাদেশে গেছে। কেন স্কুলের বইয়ে তো তাই পড়েছি। শীতকালে শীতের দেশ থেকে অতিথি পাখিরা আসে । আবার গরমকালে যখন পাখিরা ফিরত, মনে হত বাংলাদেশে থেকেই ফিরেছে। পাখি হতে ইচ্ছে করলেও তবে গাছ হতে কখনও খুব ইচ্ছে করত না আমার। তবে গাছদের একটা ব্যাপার ভাল লাগত। শীতকালে পাতা ঝরে এক একটা গাছ টেকো বুড়োর মতো হয়ে যেতো । কিন্তু গরম আসতেই কিশোরী হতো। তারপর সবুজ শাড়িতে মুড়ে ঊর্বশী হয়ে উঠত। গাছেদের যৌবন যায়, যৌবন আসে। মানুষের সেরকম নয়। মানুষের যৌবন  সে কারণেই খুব দামী। আমি গাছপালা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। কোনটি কোনটি বাংলাদেশের, মনে মনে তার তালিকা করতাম। দুটি গাছ দেখে আমি নিশ্চিত হলাম এরা বাংলাদেশের। এর একটি অবশ্যই  সফেদা এবং  অন্যটি আমড়া গাছ। কিন্তু গাছে ফল আসতেই আমার ভুল ভাঙল। বৃক্ষ তুমি কি? ফলেই পরিচয়। ভীষণ মন খারাপ হল আমার। এখানে কিছুই আমার নয়। দেশের মত নয়, যেন অন্যের আঙিনায় হেঁটে চলেছি আমি।

দুইদিন পর ইয়ামিনী আসল। ইয়ামিনীর বড় বোন নন্দিনী আর তার দুলাভাই ইয়ামিনীকে দিয়ে গেলেন। নন্দিনী আমাকে বাংলায় বললো, কেমন আছো?  ইয়ামিনীকে যেরকম ভেবেছিলাম সেরকম নয়। চমৎকার একটি মেয়ে। আমাদের থেকে বয়সে ছোট। গ্রাজুয়েশন করেই চলে এসেছে। ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার আগেই এপ্লাই করেছে। ইয়ামিনীর থেকে আরও বেশি চমৎকার তার মা আর বোন দুলাভাই। ইয়ামিনীর মায়ের সাথে ফোনে কথা হল। বললেন, ছোট বোনটাকে দেখে রেখো। ইয়ামিনী ছিল কেরালার  মেয়ে। বড্ড চঞ্চল। আসার পরদিনই, সে বললো আমাকে সুরিয়ার বাসায় নিয়ে চল। সুরিয়া তো তোমার পাশেই থাকে। এদিকে মথু টেক্সাস থেকে ফিরেছে। সুরিয়া বলেছে মথু আর আমি একসাথে থাকি ইয়ামিনী যেন না জানতে পারে। ওকে ভুলেও কোনোদিন আমার বাসায় আনবে না। আনলে আগে থেকে বলবে, মথুকে কোথাও সরিয়ে ফেলব।

নতুন বাসায় আমি একটা পার্টি দেওয়ার চিন্তা করলাম। এতদিন ভাবীরা অনেক আদর যত্ন করেছেন। এবার আমারও কিছু করা উচিৎ। পার্টিতে শুধু বিবাহিতরা দাওয়াত পেল। জারিফ ভাইয়ের বউ দেশে। বিবাহিত হওয়ার কারণে সেও দাওয়াত পেল। সেদিন ওয়ালমার্টে বেকহাম আমাদের রাইড দিল। বেকহাম সুরিয়ার ফ্রেন্ড, ব্লাক আমেরিকান। তাকে যতবারই দেখেছি মনে হয়েছে  রাইড দেওয়ার জন্য সে ছটফট করছে। আমরা কখনও রাইড নেইনি। আজকে রাইড নিয়ে তার ছটফটানি কমালাম। বেকহাম বললো, তোমরা কে কার সাথে থাকো?  সুরিয়া বললো, আমরা তিনজন একসাথে থাকি। সুরিয়ার অপ্রয়োজনীয় মিথ্যায় ইয়ামিনী প্রচণ্ড অবাক। সুরিয়া ইয়ামিনীকে বললো, দেখ, ছেলেরা কখনই ভাল নয়। এখানে সব ছেলে খারাপ। কাউকে বিশ্বাস করবে না। এরা তোমাকে অ্যাটাকও করতে পারে। তাই তিনজন একসাথে থাকার কথা বললাম।  তাহলে এটাকের পরিকল্পনা থাকলেও তিনজন দেখে পিছাবে, ভয় পাবে। বাসায় এসে দেখি, ইয়ামিনী ভয়ে অনেকটা মুষড়ে পড়েছে। বললাম, দেখ এসবের কোনটাই সত্যি নয়। এখানে তুমি না চাইলে, কেউ তোমাকে কিছু করবে না। এই এই কারণে সুরিয়া এই এই বলেছে।  মথুকে নিয়ে লুকোচুরি সুরিয়া বেশিদিন করতে পারলনা। বলল, ঘটনা এই। তবে জানো মথু কিন্তু আমাকে এখনও ছোঁয়নি।

পার্টির দিন অনেকগুলো নাস্তা বানানোর চেষ্টা করলাম। আগে নাসরিন রান্না করত, আমি পেয়াজ কাটতাম, সবজি কাটতাম, নেড়ে দিতাম, থালা বাসন ধুতাম। তখন  মনে হয়েছিল সব তো আমিই করি শুধু নাম হয় নাসরিনের। তবে বুঝলাম রান্না ব্যাপারটি এত সহজ নয়। যেটিই বানাই, সেটিতেই গুবলেট পেকে যায়। শেষে রেগেমেগে, ভাবীদেরকে বললাম, দাওয়াতে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন। আমি কিছু নাস্তা বানিয়েছি। নাস্তা খেয়েই ওনারা কাজে লেগে যাবে। দাওয়াতের রান্না তারাই করবে। এই অভিনব দাওয়াতে ভাবীদেরকে খুশিই মনে হল। ভাবীরা অনেক নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসল। আমিও কিছু অখাদ্য বানিয়েছিলাম। তারপর তারা কাজে নেমে পড়ল। কান্তা আপুর আসতে একটু দেরি ছিল।  সে ফোন করে  বললো, এই পোলাও যেন কেউ না করে। পোলাওটা আমি রান্না করব। এর মধ্যে রামিসা আর নুশেরা আমাকে অস্থির করে তুলল। তন্দ্রা আন্টি প্লিজ আমাদেরকে একটা খেলনা দাও। আমি আমার আলো জ্বলে ওঠা বার্বি ডল দিলাম। কিছুক্ষণ পর তারা জানালো তাদের নতুন খেলনা চাই। এক খেলনায় তারা বিরক্ত হয়ে গেছে। আমি খেলনা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা আমার  সাজগোজের জিনিস নিয়ে খেলতে শুরু করল। বেশির ভাগই ভেঙ্গে চুরমার করল। এদিকে ভাবীরা রান্না ঘর থেকে ডাকছে, তন্দ্রা পেয়াজ কই, তেল কই, গরম মসলা কই। কোথায় আছে দেখিয়ে দিতে লাগলাম। আর এক ভাবী আবার ডাকল।

-রসুন আর নেই?

নেই। আমিতো ভেবেছি এই রসুনে হয়ে যাবে।

-না না এত কম রসুনে আমি রান্না করতে পারব না। শেষে আমার রান্না  অন্যদের থেকে  খারাপ  হয়ে যাবে।

আমি সুরিয়ার বাসায় ছুটলাম রসুন আনতে। রসুন এনে দেখি, ভাইয়ারা বলছে, কতক্ষণ ধরে তোমাকে খুঁজছি। নামাজ পড়ব, জায়নামাজ দাও।

-এতজনের জায়নামাজ নাই।

বিছানার চাদর দাও।

-নতুন বাসা, কাপড় চোপড় ক্লোজেটে ডাম্প করে রেখেছি। বিছানার চাদর কোথায় মনে নেই।

চাদর খুঁজতে ক্লোজেটে খুললাম। সাথে সাথে নুশেরা আর রামিসাও ঢুকে পড়ল। যেন তারা একটি নতুন পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছে। কাপড় চোপড় ছিটিয়ে দাপাদাপি করে একাকার করল। এর মাঝে ইফতেখার ভাই এসে বললেন, বাথরুমের দরজা নাকি লক হয়ে গেছে। বাচ্চারা কেউ লক করে ফেলেছে। তুমি মেইন্টেনেন্সকে ফোন কর। নতুন বাসা নিয়ম কানুন জানি না। সুরিয়াকে বললাম। সুরিয়া বললো, আজকে ছুটির দিন, খবরদার মেইন্টেনেন্সকে ফোন করবে না। ওরা কত চার্জ করবে জানো। আজকে কষ্ট করে থাকো। কালকে উইক ডে। কাল ডেকো। ফ্রি করে দেবে। আর ইফতেখার ভাই আর যারা বাথরুমে যেতে চায়, বল আমার বাসা থেকে ওজু করে যেতে। মথু বাসায় নেই। অসুবিধা নেই। আমি ইফতেখার ভাইকে বললাম, ভাইয়া ওজু করতে পাশের বিল্ডিঙে যেতে হবে।

-কি! ওজু করতে পাশের বিল্ডিঙে যেতে হবে মানে?  তুমি মেইন্টেনেন্সকে ফোন দাও।

আমি মেইন্টেনেন্সকে ফোন দিলাম। খুব ইমার্জেন্সি। বাথরুম আঁটকে আছি, এক্ষুনি আসো। ওরা বললো ৩০ মিনিটের মধ্যে আসছি। এর মাঝে একজন এসে বললো, জারিফ ভাইয়া চুলের ক্লিপ দিয়ে লক খুলে ফেলেছে। আমি তাড়াতাড়ি মেইন্টেনেন্সকে ফোন দিলাম। বললাম, দরকার নেই। ইমার্জেন্সি  কেটে গেছে। আর আসতে হবে না। বাথরুমের লক খুলতে পেরে জারিফ ভাইয়াকে খুব গর্বিত মনে হল। কান্তা আপু বললো, ইঞ্জিনিয়ার জারিফ এদিকে আস, তন্দ্রার বাসায় সব হলুদ আলো জ্বলছে। লাইট কেনা আছে। সব সাদা লাইট লাগিয়ে দাও। ইঞ্জিনিয়ার জারিফ ভাই মহা আনন্দে আমার বাসার লাইট বদলাতে লাগল। যেখানে দরকার নেই, সেখানেও করল।

এদিকে ভাবীরা ডাকল, তন্দ্রা পাতিল কই? আর পাতিল নাই?

-ভাবী এইটাই তো পাতিল।

এই পাতিলে রান্না করলে লেগে যাবে তো। আচ্ছা সমস্যা নেই। মাছটা হলে আমি ঐটাতে বসাচ্ছি। তবে এই পাতিলে রান্না করতে পারব না। শেষে আমার রান্না  অন্যদের থেকে  খারাপ  হয়ে যাবে। এদিকে আমার রুমে এসে দেখি। সেটির লন্ডভণ্ড অবস্থা। সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে নুশেরা আর রামিসা ভূত ভূত খেলছে। এর মাঝে মোবাইলটিও খুজে পাচ্ছিনা। রিং হচ্ছে কিন্তু লন্ডভণ্ড ঘরে ওটার ট্রেস করতে পারছিনা। এদিকে কান্তা আপু এসে বললো, পোলাও কি দুধ ছাড়া  করব নাকি দুধ দিয়ে করব? চাল কি ভেজে করব? না, না ভেজে করব? চাল জনপ্রতি একপট দিব? না, দেড় পট দিব?

-আপু, করেন আপনার ইচ্ছে মত করেন।

না না তোমার বাসা তোমাকে তো বলতেই হবে।

আমি মনে মনে নাসরিনের অসীম প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। পিয়া আমাকে এক কোনে চুপি চুপি ডেকে বললো, আপু বুঝেছেন তো দাওয়াত দিলে কি হয়। খেতে বসে একজন বললো, মাংস হালাল স্টোর থেকে কেনা তো? না ওয়ালমার্টের  মাংস? ভাবীরা যে হালাল ছাড়া খায় না, আমি বেমালুম ভুলে গেছি। অনেকে বললো, আরে একদিন খাও, খেলে কিছু হবে না। আর একজন বললো, মুরগীটা খাও। গরুটা খেও না। মুরগী ছোট প্রাণী, ‘হালাল না’ খেলে কিছু হয় না। সেদিন অধিকাংশই এই একটি দিনের জন্য হালাল কি ‘হালাল না’ বিচার করে নি। চেটে পুটে খেয়েছে। ভাবীদের রান্নাও খুব চমৎকার হয়েছিল। আর ভীষণ চমৎকার একটা দিন আমার কেটেছিল।

পরদিন আমার ফ্লাইট। অরিগন যাচ্ছি। হোসেন  আমাকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত  রাইড দিচ্ছে। প্রথমদিন আমেরিকা আসার পর আমি এই দ্বিতীয়বার এয়ারপোর্ট যাচ্ছি। সেই একই পথ, একই মাঠ ফেলে। তবে দিনের আলোয় সেই একই পথ আলাদা মনে হচ্ছে। আলো অন্ধকারের তফাৎ সবকিছু বদলে দিচ্ছে। আমাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে হোসেন চলে গেলো। যাবার আগে কানে কানে বললো, আর একা থেকো না। অরিগনে যেয়ে কাঊকে জুটিয়ে ফেলো। হোসেনকে বিদায় দিয়ে আমি সিকিউরিটি চেকে ঢুকেছি। সিকিউরিটি অফিসার অরিগনে আমি বোমা নিয়ে যাচ্ছি কিনা চেক করছে। আমি সন্ত্রাসী কিনা জানার জন্য  আমাকে অনেক প্রশ্ন করছে। সে সবের কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না। আমার মাথায় শুধু আমি অরিগন যাচ্ছি। অরিগণের উত্তরে প্রশান্ত, আর একদিকে বয়ে গেছে কলোম্বিয়া রিভার। এই কলোম্বিয়া রিভারকে নিয়ে কবি গুথেরিক লিখেছিলেন তার কবিতা “Roll on, Columbia, Roll On” । অরিগন বারো মাস মেঘে ঢাকা থাকে। মেঘের দেশ অরিগন। সেখানে বারো মাস বৃষ্টি পড়ে। বাংলাদেশের  মতো ঝমঝমে বৃষ্টি না টিপটিপ বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি যেয়ে প্যাসিফিকে মেশে। প্যাসিফিক, প্রশান্ত মহাসাগর, মহা সমুদ্র। সমুদ্র আগেই দেখেছি আমি। একাই দেখেছি। এবার মহাসমুদ্র দেখবো আমি। সেটিও একাই। মহাসমুদ্র দেখতে আমি অরিগন যাচ্ছি। ট্রানজিট কলোরাডোর ডেনভার বিমান বন্দর।

 


প্রবাসে সিরিজের গল্পসমূহঃ

 পর্ব ১ঃ যাত্রাপথের গল্প
 পর্ব ২ঃ নতুন বাসা, ওরিয়েন্টেশন, রাস্তা হারানো
 পর্ব ৩ঃ পুলিশ আসা, রেজিস্ট্রেশন বিড়ম্বনা
 পর্ব ৪ঃ ডরমেটরির গল্প, প্রথম তুষারপাত
 পর্ব ৫ঃ ইন্টারন্যাশনাল নাইট, বাসা নিয়ে ঝামেলা, শায়লা আপুর চলে যাওয়া
 পর্ব ৬ঃ কামরানকে হাসপাতালে নেওয়া, টেকো সুদীপ আর ব্রিটিশ প্রফেসরের গল্প
 পর্ব ৭ঃ ল্যাব ও ফরাসী যুবকের হৃদয় ভাঙার গল্প।
 পর্ব ৮ঃ সামার এসেছে, বেতন পাইনি, প্রথম বাসা ছেড়ে দিলাম
 পর্ব ৯ঃ সঙ্গীহীন জীবন, সুরিয়া মথুর গল্প, সামারের দিনলিপি, একা পথ চলা
 পর্ব ১০ঃ বিদেশী ভাষা শেখা ও আমেরিকান চাষাবাদের গল্প
 পর্ব ১১ঃ আমার বাইবেল শেখা
 পর্ব ১২ঃ সাজ্জাদের চলে যাওয়া, লিবিয়ান পরিবারের গল্প
 পর্ব ১৩ঃ মুহিত ভাইয়ের গল্প, আমার আগুন ধরিয়ে ফেলা
 পর্ব ১৪ঃ মসজিদ, ঈদ, ইয়ামিনী আসা, নতুন বাসা, আমেরিকান বিয়ে ও অরিগন যাবার গল্প
 পর্ব ১৫ঃ
 পর্ব ১৬ঃ
 পর্ব ১৭ঃ
 পর্ব ১৮ঃ
 পর্ব ১৯ঃ

লেখক পরিচিতিঃ

 জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ ক্যারোলিনা এ এন্ড টি স্টেট’ ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ‘PhD’ করছেন এবং তার গবেষণার বিষয় হল ‘Real time Object detection with Higher Accuracy’। jannatunজান্নাতুন নাহার তন্দ্রার স্কুল জীবন কেটেছে চুয়াডাঙ্গা শহরে, কলেজ জীবন হলিক্রস কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। এবং সেখান থেকেই ২০১০ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষে ২০১২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং ২০১৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা অবসরে লিখতে ভালবাসেন এবং সে অভ্যাস বশতই আমেরিকার গ্রাজুয়েট প্রোগামে একা একটি মেয়ে পড়তে আসার অভিজ্ঞতা (সাউথ ডাকোটা) একসময় তিনি লিখতে শুরু করেন। এবং তার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘প্রবাসে’ নামে ২০১৫ সালের ‘একুশে বই মেলায়’ তার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি কোন তথ্যমূলক বই নয় বরং বলা যায় এটি লেখিকার রোজকার ডায়েরী।