নতুন সেমিস্টার শুরু হতে বেশ বাকী। সবাই বেশ ফ্রি, প্রায়ই কোন না কোন ভাবীর বাসায় দাওয়াত থাকে। আমি আর নাসরিন খুব সাজগোজ করি। তারপর সাজ্জাদের গাড়িতে চড়ে দাওয়াত খেতে যাই। আশিক আর কামরান ও থাকে। আমাদের সবার খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়। আশিককে আর এত খারাপ লাগে না এখন। ওর কথা গুলো আমি এখন মজা হিসেবে নেই। মনির ভাই চলে যাবার পর কামরান সাজ্জাদের সাথে ওঠে। কামরান বলে সে খুব ভাল রোস্ট করতে পারে। সে সবাইকে একদিন রোস্ট করে খাওয়াতে চায়। রোস্ট রান্নার নানা বর্ণনা সে দেয়। সে দাবী করে, তার রান্না রোস্ট খেলে কেউ তাকে এবং তার রোস্ট দুটোই ভুলতে পারবে না। তবে রান্না করতে তার একটু বেশী সময় লাগে।

আমরা ব্যতিক্রমধর্মী রোস্টের দাওয়াত পাই। নাসরিন দাওয়াত এর জন্য পুডিং বানায়। আমরা সাজ্জাদের জন্য অপেক্ষা করি। সাজ্জাদ আসে না। শরিফ ভাই এসে আমাদের নিয়ে যায়। যেয়ে দেখি অনেক মানুষ বসা, রান্না বান্না চুলোয় চড়েনি। কামরান মুরগী কাটতে যেয়ে হাত  কেটে ফেলেছে। খুব খারাপ ভাবে কেটেছে। কাউসার ভাই ওকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে। সাথে সাজ্জাদও গেছে।

ওরা হাসপাতাল থেকে ফিরে। কোন সেলাই লাগেনি। তবে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। কামরান ব্যাতিক্রমধর্মী রোস্ট না খাওয়াতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করে। আমি আর নাসরিন হাত লাগাই। আমি পোলাও চাপিয়ে দেই। কামরান নির্দেশনা দিতে থাকে। নাসরিন আর আমি ওর নির্দেশনা অনুযায়ী মুরগী ভেজে ফেলি। কামরান কিছুক্ষণ পর পর খেয়ে দেখে মুরগী ঠিকমত ভাজা হচ্ছে কিনা। ভাজা শেষ হলে লাস্ট ফিনিশিং সে দেয়।

একসময় রান্না বান্না শেষ হয়। ততক্ষনে সবার ভীষণ ক্ষুধা লেগে গেছে। আমরা কামরানের ব্যতিক্রমধর্মী রোস্ট খাই। খুব সাধারন রান্না মনে হয় আমার কাছে। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা চলে আমাদের। জিমি ভাবীর ছোট বাচ্চার কারণে উনি উঠতে চান। রায়হান ভাই –পিয়ারাও যেতে চায়। আমরাও উঠে পড়ি।

পরদিন আশিকের বাসায় দাওয়াত থাকে। আশিক আরও তিনটি ভাইয়ার সাথে থাকে। তারা কেউ আশিকের মত নয়। ভীষণ লাজুক, কম কথা বলেন। আশিক খুব ভাল রান্না করে। আশিকদের বাসায় হাঁসের মাংস, ছোট মাছ আর চিংড়ি ভর্তা করা হয়। নাসরিন আশিকের সহকারি হিসেবে কাজ করে। রান্না শেষে আমি হাড়ি পাতিল ধুয়ে দেই। অনুমানের তুলনায় অনেক বেশি লোক এসে পড়ে। এক ভাই –ভাবী, আজ রাতে তারা ভার্জিনিয়া থেকে ফিরেছেন। হাঁসের মাংস শুনে তারাও এসে পড়েন। জম্পেশ আড্ডা হয়। আমরা গানের কলি খেলি, নাসির ভাই প্রতিটি গান বানিয়ে গায়। এ নিয়ে খুব হাসাহাসি হয়। রুমা আপু অনেকগুলো গান করে। রুমা আপুর গান শুনে মন খারাপ হয়ে যায়। নিজের গানের গলার জন্য অনুশোচনা হয়। ভীষণ ভাল লাগে আপুর গান।

নাসির ভাই আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেয়। পরদিন শুনি হাসপাতাল থেকে কামরানের বিল এসেছে। সাতশো ডলার। কামরান খুব ঘাবড়ে যায়। নাসির ভাই অভয় দেন। আমেরিকার চিকিৎসা ব্যবস্থা এমন, তোমার পকেটে কিছু না থাকলেও ওরা তোমাকে বেস্ট সেবাটা দিবে। তারপর চিকিৎসা শেষে একটা গলাকাটা বিল পাঠাবে। একটা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিবে টাকা আদায়ের। তুমি একবারে না দিতে পারলে তোমার ইনকাম অনুযায়ী প্রতিমাসে টাকা কাটবে। তাতেও তোমার অসুবিধা হলে তুমি চ্যারিটিতে এপ্লাই করতে পার। অনেক সময় মাফ হয়ে যায়। আমারও এরকম হয়েছিল। মাফ হয়ে গেছে। নাসির ভাইয়ের কথা শুনে কামরান কিছুটা স্বস্তি পায়। কামরান চ্যারিটিতে এপ্লাই করে। পাঁচশো ডলার মাফ হয়ে যায়, ওকে দুশো ডলার দিতে হয়।

জানুয়ারি মাস শুরু হয়ে গেছে। সেমিস্টার প্রায় শুরুর দিকে। প্রায় প্রতিদিনই তুষার পাত হয়। সবাই কেমন হাঁপিয়ে ওঠে। নতুন এক ভাইয়া আসে নতুন সেমিস্টারে। তুষারে ঢাকা শহর দেখে তার খুব মন খারাপ হয়। তুষারপাত দেখলে আমার আর এখন মন খারাপ হয় না। জানালা দিয়ে বৃষ্টির মত তুষার দেখি। মাঝে মাঝে দরজা খুলে তুষারের মাঝে দাঁড়াই। আমার গায়ে চোখে মুখে তুষার পড়তে থাকে। বরফে ঢাকা সাদা শহর, তার মাঝে আমি দাঁড়িয়ে। নিজেকে ভীষণ অচেনা মনে হয়। আমি কেঁপে উঠি।

ঠান্ডায় আমার কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে। আমি ভিতরে আসি। আবার সাদা মখমলের মত তুষার দেখি। দু’ একটি গাড়ি চলছে ভীষণ টিম টিম করে, যেন গন্তব্যে যাবার বিশেষ তাড়া নেই। রেস্টুরেন্টটাতেও বেশি ভিড় নেই। সবাই যেন গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। আমার ঘুম আসে না। নাসরিনও ঘুমায়নি। কার সাথে জানি কথা বলছে।

শায়লা আপু চলে যাবার পর আমি ওনার রুমে উঠেছি। বড় রুম, দুটো কাবার্ড, জিনিসপত্র রাখতে সুবিধা হয়। ভিতরে কার্নিশের সিড়ি আছে, বসাও যায়। তবু আমি খুশি হতে পারি না। ভীষণ ভয় করে আমার। মনে হয় এই জানি কেউ দরজা খুলে ফেলবে আর আমি পালানোর জায়গা খুঁজে পাব না। পালাবার পথ পেতে আমি ডাইনিং এ ঘুমাই। ডাইনিং থেকে বাসার সামনে পিছনে দুদিকেই যাওয়া যায়। আলো নিভিয়ে দিলে রেস্টুরেন্টের অল্প আলো ঘরে আসে। অল্প আলো আমার কাছে কেমন বাংলাদেশের জোৎস্নার মত মনে হয়। আমি জোৎস্নার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি।

ঘুম থেকে উঠে আব্বুকে ফোন করি। তুষারপাতের গল্প বলি। আব্বুকে বলি, আব্বু –আম্মু আমেরিকা আসলে তুষারপাত দেখাবো তাদের। কিন্তু আব্বু এখনি দেখতে চায়। স্কাইপে ভিডিও কানেক্ট করার খুব চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু বোঝা যায় না। ভিডিও কল কিছুক্ষণ পর পর কেটে যায়। আব্বু খুব আক্ষেপ করে। তিনি বলেন একটা মিস্ত্রী এনে কম্পিউটারটা ঠিক করা দরকার।

নেটওয়ার্কের সমস্যা শুনে আব্বু–আম্মু বড় আপুর বাসা চিটাগাং চলে যায়। আমি তাদেরকে আমার বাসা দেখাই, বাসার কায়দা কানুন দেখাই, আমেরিকার রাস্তা ঘাট দেখাই। আব্বু খুব মুগ্ধ হয়ে দেখে, অনেক প্রশ্ন করে। আম্মু কিছুই বলে না, কিছুতে মুগ্ধ হয় না। আমার মোটা শরীর দেখে বলে, এত শুকিয়ে গেছিস কেন। আব্বুকে আমি তুষারপাত দেখাতে পারি না। ক’দিন ধরে তুষারপাত হয় না। আব্বুকে আরো দুদিন থাকতে বলি। অফিসের ছুটি শেষ, আব্বু আম্মুকে রেখে চলে যায়।

প্রচণ্ড বরফ পড়ে কদিন। আমি আম্মুকে দেখাই, আপুকে দেখাই। ওরা কেউ মুগ্ধ হয় না। কিছুক্ষণ দেখে তারপর সাংসারিক গল্পে ফিরে যায়। আমি ছোট বোন ঐশীকে দেখাই। আমি বরফ হাত দিয়ে ছুড়ে মারি, তারপর হু হু করতে করতে ভিতরে চলে আসি। আমার কাঁপুনি দেখে ও হেসে কুটি কুটি হয়। আমিও হেসে হেসে কুটি কুটি হই। ও অনেক গল্প করে আমার সাথে। ঈদে আমাকে কতটা মিস করেছে। তাকে সাজিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না। ওলিও তাকে কোথাও নিয়ে যায়নি। ওলি এবার বাসায় আসলে ওলিকে কি কি গল্প করবে আমাকে শোনায় সে।

আমি মুগ্ধ হয়ে ওর গল্প শুনি।

সেমিস্টার শুরু হয়ে যায়। আমাকে ল্যাবের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। ল্যাবটা অনেকটা অফিসের মত। আমি ঘুরে ঘুরে ল্যাব দেখি। আমেরিকান একটি ছেলের ডেস্কে অনেক ছবি লাগানো। ছবিতে সে একটি মেয়েকে চুমু খাচ্ছে। চুমু দেখে মনে হয়, মেয়েটির ঠোটের অর্ধেকটা খেয়ে ফেলতে চায় সে। ছেলেটি বলে, হাই আমি ফ্রাঙ্ক আর যে ছবিটা দেখছ আমার বর্তমান গার্লফ্রেন্ড।

ল্যাবে আমি অনেক আমেরিকান দেখি। গ্রাজুয়েট লেভেলে আমেরিকানদের উপস্থিতি খুব কম দেখা যায়। আমেরিকা পড়তে আসার আগে আমার ধারণা ছিল আমেরিকানরা খুব শিক্ষিত জাতি, কি সুন্দর ইংরেজি বলে। এখানে এসে বুঝেছি ওরা বারো ক্লাসের বেশি পড়ে না। বারো ক্লাস পর্যন্ত ওদের কলম খাতা থেকে সবকিছু ফ্রি। বারো ক্লাসের পর যারা লেখাপড়া শিখতে ভীষণ আগ্রহী তারাই পড়ে আর বাকিরা কাজে নেমে পড়ে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা এখানে সবচেয়ে ব্যায়বহুল জিনিস। অনেকটা বাংলাদেশের উল্টো। বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বলা যায় অনেকটা ফ্রিতে পড়ানো হয়।

এখানে যাদের টিউশন ফি যোগাড়ের সামর্থ্য থাকে না তারা কয়েক বছর কাজ করে। টাকা জমায় তারপর পড়তে আসে। আমার টি এ ল্যাবে একটা স্টুডেন্ট ছিল সে বিশ বছর মিলিটারিতে চাকরি করে রিটায়ার্ড করেছে, তার হাতে এখন অখণ্ড অবসর তাই এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। তার ছেলেও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। আর একটি মেয়ে, নাসরিনের স্টুডেন্ট, তার তিনটা বাচ্চা আছে। তার স্বামী একজন প্লাম্বার, বাড়ি বাড়ি পানির কল ঠিক করে। ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল মেয়েটির। তাই এখন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছে।

আমি হায়ার এডুকেশনে আমেরিকান ভীষণ কম দেখি। সব দেখি চাইনিজ, ইন্ডিয়ানরা দখল করে বসে আছে। অন্যরাও আছে। আমেরিকার সব গবেষণা এরাই করে। কিন্তু গবেষণা শেষে সবাই জানে আমেরিকার এক দল গবেষক এটা বের করেছে। তবে এজন্য আমেরিকাকে আমার খারাপ মনে হয় না। ওরা আমাদের খেতে পরতে দেয়। বিনে পয়সায় পড়ায়, সবচেয়ে সুবিধাওয়ালা রিসার্চ ল্যাব দেয়, চিন্তা করার সুযোগ দেয়। শুধু চিন্তা শেষে ফলাফলটা নিজের দেশের বলে চালিয়ে দেয়। মাঝখান থেকে আমাদের মাস্টার্স হয়, পি এইচ ডি হয়।

আমেরিকাকে আমার পৃথিবীর উত্তম পাঠশালা মনে হয়। আমি পৃথিবীর উত্তম পাঠশালায় মনোযোগ দেই।

ল্যাবে কাজকর্ম করি। আমি একাই ফিমেল স্টুডেন্ট এখানে। সবাই আমাকে খুব ভালবাসে। নিজেকে রাজকন্যা মনে হয় আমার। আমাদের ল্যাবের কাজ স্যাটেলাইট ইমেজ ক্যালিব্রেসন নিয়ে। আমি রিমোট সেনসিং এর একটা কোর্স নেই। এক ব্রিটিশ প্রফেসর পড়ান। প্রথম ক্লাসে এসেই উনি আমেরিকার চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারটা রাশিয়াকে টেক্কা দেওয়ার জন্য যে একটি বানোয়াট ব্যাপার, কৌশল করে বলেন। তারপর আমেরিকার ভীষণ বদনাম করেন। এরা ভীষণ একগুয়ে, নিজেরা যেটা বলে সেটাই। সারা বিশ্ব চলে এম কে এস ইউনিটে। তারা চলে এফ পি এস ইউনিটে। কারণ একটাই, এম কে এস ব্রিটিশরা বানিয়েছে। তাদেরও এখন কিছু বানাতে হবে। আজকের তাপমাত্রা কত বিশ ডিগ্রি ফারেনহাইট, শুনে মনে হবে স্কেল শুন্যের উপরে, কি উষ্ণ একটি দিন ! আসলে বরফে ঢেকে আছে সব কারণ মাইনাস সেভেন ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটার কোন মানে হয়, মানে একটাই সবকিছুতে তাদের প্রথম হওয়া চাই। রাশিয়ানরা যখন প্রথম মহাশুন্যে গেল, জ্বলে গেল আমেরিকানদের, মিথ্যে গল্প ফাঁদল। আমেরিকানরা চাঁদে গিয়েছে। রাশিয়া তো চাঁদে যেতে পারেনি। পৃথিবীর প্রথম চন্দ্র ভ্রমণকারী আমেরিকান। আমেরিকার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ শেষে উনি বলেন, তবুও উনি কেন আমেরিকা এসেছেন। কারণ উনি মনে করেন আমেরিকা গবেষণার জন্য উত্তম স্থান।

উনি আমাদের পড়ানো শুরু করেন। আমাদের সবার একটি করে এনিমেল নাম থাকবে, যেটি প্রফেসর ছাড়া আর কেউ জানবে না। সবার গ্রেড প্রতি সপ্তাহে এনিমেল নামের পাশে দিয়ে দেওয়া হবে। যাতে সবাই তুলনা করতে পারে সে অন্যদের তুলনায় কতটুকু ভাল বা খারাপ করছে কিন্তু কে কোন গ্রেড পেয়েছে কেউ জানতে পারবে না।

উনি জিজ্ঞেস করেন এতে কারো আপত্তি আছে কিনা। সবাই বলে আপত্তি নেই। তারপর উনি বলেন, তোমরা কি জানো ইন্ডিয়াতে কি ভয়াবহ ব্যাপার ঘটে। সবার গ্রেড নাম সহ টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়। তার মানে সবাই সবারটা জেনে ফেলে। সবাই ও মাই গড ও মাই গড বলে ওঠে। এরকম অদ্ভুত নিয়ম থাকতে পারে জেনে ওরা ভীষণ অবাক হয়। আমার খুব হাসি পায়।

ক্লাস শেষ হয়, এই ক্লাসটা জি আই এস ডিপার্টমেন্টে। এখান থেকে ইলেকট্রিকাল ডিপার্টমেন্ট বেশ খানিকটা পথ। আমি খুব দ্রুত হাঁটি। তবু আমার হাত–পা মুখ জমে যায়। পৌঁছে ওভারকোট খুলে দেখি ঘেমে শার্ট ভিজে গেছে। জ্যাকও পৌঁছে গেছে। ও সবসময় সাইকেল চালিয়ে আসে। মাঝে মাঝে আমার সাথে দুষ্টুমি করে, তুমি তো দেখি আমার সাইকেলের থেকে জোরে হাঁটো ।

এত ঠাণ্ডায় সাধারণত কেউ সাইকেল চালায় না। জ্যাককে আমার খুব গরিব আমেরিকান মনে হয়। একদিন জ্যাক এর সাথে গল্প করি। গ্রাজুয়েশন এর পর সে কি করবে। ও বলে, এখানে ওর জন্ম, এখানে বেড়ে ওঠা, ও হাঁপিয়ে গেছে এখানে থাকতে থাকতে। সবাই আমেরিকা নিয়ে এত কথা বলে, এত উত্তেজনা সবার এই আমেরিকা নিয়ে। কিন্তু আমেরিকান হয়ে সে কিছুই দেখেনি। তাই ওর প্রথম উদ্দেশ্য একটা ভাল চাকরি খোঁজা আর বেতন দিয়ে ট্রাভেল করা।

ইন্ডিয়ান অল্প বয়সী এক মহিলা প্রফেসর আমাদেরকে একটি কোর্স পড়ান। মহিলার নাম সবিতা। জ্যাক সবিতাকে ক্লাসে বলে, তুমি যে পদ্ধতিতে পড়াচ্ছ, আমি এটা পছন্দ করছিনা। এটা রাইট ওয়ে না। এ নিয়ে মহিলার সাথে ওর অনেক ঝামেলা হয়, ও কোর্স ড্রপ করে। ও বলে, সি ইজ রেসিস্ট। দেখেছ ক্লাসে তোমরা কোন উত্তর দিলে সবিতা পছন্দ করে না। আর আমি যাই বলি তাই ঠিক। ও আগের সেমিস্টারে তোমাদের সবাইকে বি দিল আর আমাকে দিল এ। কারণ আমি আমেরিকান। আমাকে সন্তুষ্ট করলে তার চাকরি যাবে না। আই হেট হার।

বিষয়টি আমরা অনেক আগেই খেয়াল করেছি। তবু চুপ করে থাকি। আমেরিকা আসার পর মনির ভাই আমাকে বলেছিল, সবসময় আমেরিকানদের সাথে গ্রুপ করবা। কারণ অধিকাংশ প্রফেসর চাইনিজ আর ইন্ডিয়ান। এদের অনেকেই রেসিস্ট। তবে এরা আমেরিকানদের কম দেয় না। কারণ আমেরিকানরা কমপ্লেন করলে এদের চাকরীতে ঝামেলা হতে পারে। ডক্টর সবিতা ক্লাসে এখন খুব তেল দেন আমাদের। আমাদের উত্তর এখন তার কাছে ঠিক মনে হয়।

স্টাটিস্টিক্সের একটি কোর্স নেই। টম রো নামে এক থুত্থুরে বুড়ো পড়ান। ভীষণ নোংরা আর পুরনো একটা ব্যাগ নিয়ে আসেন। পড়ানোর সময় তার হাত কাঁপে। তিনি কিছুক্ষণ পড়ান আর তারপর সকার (আমেরিকায় ফুটবলকে সকার বলে) এর গল্পে চলে যান। একসময় তিনি খুব ভাল সকার গেম খেলতেন।

জ্যাক ওনার ক্লাসে প্রশ্ন করে। তুমি তো বলছ এটা এটা করলে এভাবে প্রেডিকসন করা যায়, কিন্তু কিভাবে যায় ডিটেইল তো বলছনা। আমরা তো কিছু শিখছি না। উনি বললেন, গুড কোশ্চেন জ্যাক। ভাল ছাত্ররা আমার ক্লাসে কখনো কিছু শিখতে পারে না। তাদের খুব অসুবিধা হয়। এরপর উনি আবার সকারের গল্পে চলে যান।

এরকম বুড়ো প্রফেসর কে কেন রেখেছে, আমার খুব অদ্ভুত লাগে। পাশের ছেলেটি বলে ওনার আন্ডারে নাকি রিসার্চও হয়। ছেলেটিকে দেখে বুঝি ও কোন আরব দেশের। ওরা নিজেদের মধ্যে যখন কথা বলে আমার মনে হয় ওরা কুরআন তেলোয়াত করছে।

আমি ক্লাস শেষে ল্যাবে চলে আসি। ল্যাবে সুদীপ নামে নেপালি একটি টেকো ছেলে আমার পাশে বসে। বয়সে আমার থেকে ৬/৭ বছরের বড়। সে কিছুক্ষণ পর পর আমার সাথে কথা বলে। ভীষণ বিরক্ত লাগে আমার। সে আমাকে নানা প্রশ্ন করে। আমার এখানে থাকতে কোন অসুবিধা হয় কিনা, আমি রান্না করতে পারি কিনা। আমি বলি, আমি পারি। তাকে জিজ্ঞেস করি সে পারে কিনা। সে বলে সে খুব ভাল রান্না পারে। আমাকে তার রান্না পারার গল্প বলে। আমার চোখে পানি এসে যায়।

সুদীপের বাসা নেপালের এক প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে। যেখানে এখনো পর্যন্ত বিদ্যুৎ যায়নি। দুর্গম পাহাড়ি রাস্তার কারণে যেখানে ভ্যান, রিক্সা পর্যন্ত চলে না। রিক্সা স্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে হলে এখনও এক মাইল হাঁটতে হয়। সুদীপের বাবা–মা কৃষক। দুজনই ক্ষেতে কাজ করে। ওর দুটো ছোট ভাই বোন আছে। ও বাড়িতে থাকে, ছোট দু ভাইবোনকে দেখে রাখে। রান্না করে, সংসারের সব কাজ করে আর মাঝে মাঝে স্কুলে যায়। আর যখন ফসল ওঠে, তখন ওর বাবা –মা আরো বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই তিন চার মাইল হেঁটে সুদীপ সেগুলো মাথায় নিয়ে বাজারে বেচতে যায়। বেচার পর আবার তিন চার মাইল হেঁটে ফিরে আসে। সুদীপের বাবা- মা সংসারে সচ্ছলতা আনার খুব চেষ্টা করে।

কিন্তু তারপরও পারে না। সুদীপ স্কুলে গেলে তারা খুব রেগে যায়। তাতে ছোট দুই ভাই বোনের অযত্ন হয়, বাড়িতে রান্না চড়ে না, টাকা পয়সায়ও টানাটানি পড়ে। সুদীপের খুব মন খারাপ হয়, তার খুব স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে। এভাবে সুদীপ এর ১০থ গ্রেড শেষ হয়ে যায়। সুদীপ মেট্রিকে খুব ভাল করে। তারপরও ওর বাবা –মা ভরসা পান না। ওকে লেখাপড়া শিখতে মানা করেন। একদিন খুব অভিমান করে অল্প কিছু টাকা নিয়ে বাসা থেকে পালিয়ে যায় সুদীপ। তিনদিন সে কাঠমুন্ডু রেলস্টেশনে রাত কাটায়। পাউরুটি খেয়ে থাকে। তারপর তার এলাকার এক পরিচিত জনের সহায়তায় উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়। তারপর সুদীপ আর থেমে থাকেনি। নেপালের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির সুযোগ পায়। সুদীপদের এখন একটা ইটের বাড়ি আছে। ওর ভাইটাও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। বোনটাকে বিয়ে দিয়েছে।

সুদীপ তার গল্প শেষ করে। গল্প শেষে ওর দিকে তাকাই আমি। খুব আত্মবিশ্বাসী মনে হয় ওকে। আমার চোখে পানি দেখে ও বকে আমাকে। আমাকে সাহস দেয়। আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। টেকো সুদীপকে আমার খুব ভাল লেগে যায়। আমাদের খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়। সুদীপ খুব ভাল প্রোগ্রামিং পারে। আমি ওর কাছে সমস্যা নিয়ে যাই। সামান্য জিনিস পারি না বলে ইতস্তত বোধ করি। ও আমাকে স্বাভাবিক করে।

ল্যাবে থাকতে এখন খুব ভাল লাগে আমার। আমাদের ল্যাব টাইম নয়টা থেকে পাঁচটা। তবু আমি রাত দশটা-এগারোটায় বাড়ি ফিরি। নাসরিন খুব রেগে যায়। আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়। ফেরার সময় দেখি প্রচুর ছেলে মেয়েরা স্টাডিতে বসে পড়ছে। আমেরিকানরা সব কাজ ডিপার্টমেন্টে শেষ করতে পছন্দ করে। হোম হল ওদের কাছে বিশ্রামের জায়গা। আমি হোমওয়ার্ক, সব পড়া ল্যাবেই সারি। সাজ্জাদ আমাকে বলে, তুমি তো দেখি আমেরিকান হয়ে গেছো ।


প্রবাসে সিরিজের গল্পসমূহঃ

 পর্ব ১ঃ যাত্রাপথের গল্প
 পর্ব ২ঃ নতুন বাসা, ওরিয়েন্টেশন, রাস্তা হারানো
 পর্ব ৩ঃ পুলিশ আসা, রেজিস্ট্রেশন বিড়ম্বনা
 পর্ব ৪ঃ ডরমেটরির গল্প, প্রথম তুষারপাত
 পর্ব ৫ঃ ইন্টারন্যাশনাল নাইট, বাসা নিয়ে ঝামেলা, শায়লা আপুর চলে যাওয়া
 পর্ব ৬ঃ কামরানকে হাসপাতালে নেওয়া, টেকো সুদীপ আর ব্রিটিশ প্রফেসরের গল্প
 পর্ব ৭ঃ ল্যাব ও ফরাসী যুবকের হৃদয় ভাঙার গল্প
 পর্ব ৮ঃ সামার এসেছে, বেতন পাইনি, প্রথম বাসা ছেড়ে দিলাম
 পর্ব ৯ঃ সঙ্গীহীন জীবন, সুরিয়া মথুর গল্প, সামারের দিনলিপি, একা পথ চলা
 পর্ব ১০ঃ বিদেশী ভাষা শেখা ও আমেরিকান চাষাবাদের গল্প
 পর্ব ১১ঃ আমার বাইবেল শেখা
 পর্ব ১২ঃ সাজ্জাদের চলে যাওয়া, লিবিয়ান পরিবারের গল্প
 পর্ব ১৩ঃ মুহিত ভাইয়ের গল্প, আমার আগুন ধরিয়ে ফেলা
 পর্ব ১৪ঃ মসজিদ, ঈদ, ইয়ামিনী আসা, নতুন বাসা, আমেরিকান বিয়ে ও অরিগন যাবার গল্প
 পর্ব ১৫ঃ
 পর্ব ১৬ঃ
 পর্ব ১৭ঃ
 পর্ব ১৮ঃ
 পর্ব ১৯ঃ

লেখক পরিচিতিঃ

 জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ ক্যারোলিনা এ এন্ড টি স্টেট’ ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ‘PhD’ করছেন এবং তার গবেষণার বিষয় হল ‘Real time Object detection with Higher Accuracy’। jannatunজান্নাতুন নাহার তন্দ্রার স্কুল জীবন কেটেছে চুয়াডাঙ্গা শহরে, কলেজ জীবন হলিক্রস কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। এবং সেখান থেকেই ২০১০ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষে ২০১২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং ২০১৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা অবসরে লিখতে ভালবাসেন এবং সে অভ্যাস বশতই আমেরিকার গ্রাজুয়েট প্রোগামে একা একটি মেয়ে পড়তে আসার অভিজ্ঞতা (সাউথ ডাকোটা) একসময় তিনি লিখতে শুরু করেন। এবং তার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘প্রবাসে’ নামে ২০১৫ সালের ‘একুশে বই মেলায়’ তার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি কোন তথ্যমূলক বই নয় বরং বলা যায় এটি লেখিকার রোজকার ডায়েরী।