প্রতি বৃহস্পতিবার ল্যাব মিটিং থাকে আমাদের। প্রথম মিটিং এ নিজের সম্পর্কে প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। নিজের পরিচয় শেষে, প্রেজেন্টেশনে আমি দেশের পরিচয় দেই। ইতিহাস দিয়ে শুরু করি। ব্রিটিশ শাসনের কথা বলি। এসময় ফ্রাঙ্ক চেঁচিয়ে ওঠে, দে রুল্ড আস, দে রুল্ড ইউ, দে রুল্ড এভেরিবডি। ফ্রাঙ্কের চেঁচানি থামলে আমি ওদের সুন্দরবন দেখাই, কক্সবাজার সি বীচ দেখাই। এটা পৃথিবীর বৃহত্তম সি বীচ ওরা বিশ্বাস করতে চায় না। অনেকে তাদের কাজের উপর প্রেজেন্টেশন দেয়। ফরাসি একটি ছেলের প্রেজেন্টেশন সবচেয়ে ভাল লাগে। সবচেয়ে বাজে হয় ফ্রাঙ্কের প্রেজেন্টেশন। ফ্রাঙ্ক মুখের ভিতর অর্ধেক কথা রেখে দিয়ে বলে। তার কথা বোঝা খুব কষ্ট। ফ্রাঙ্ক খুব ভাল ছাত্র। সে অনেক কিছু জানে। কিছু না বুঝলে প্রফেসর বলেন ফ্রাঙ্ক তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। তবুও আমরা কেউ ফ্রাঙ্কের কাছে যাই না। ও কিছু বলে চলে যাবার পর উদ্ধারের চেষ্টা করি, ও আসলে কি বলেছিল। আর একজন আছেন যার কথা আমরা কেউ বুঝি না। প্রফেসর এরন। সবসময় হাসতে থাকেন। তাকে আমার খুব অদ্ভুত লোক মনে হয়। তিনি পুরোটা মিটিং ঘুমান এবং মিটিং শেষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেন। প্রফেসর এরনকে আমার খুব ভাল লাগে। সবচেয়ে ভাল লাগে তার মাথার চুলের বিন্ন্যাস। বিশাল একটা মাথা তার। মাঝখানটা ফাঁকা। আর চারপাশের চুলগুলো বেশ লম্বা। কোঁকড়ান চুলগুলো ইলেকট্রিক তারের মত খাড়িয়ে থাকে। বোঝাই যায় উনি কখনও চুল আঁচড়ান না।

আরেকজন প্রফেসর আছেন আমাদের মিটিং এ, ডক্টর সবিতা। সবিতার কথা আগেই বলেছি। সবিতা সাউথ ইন্ডিয়ান। ভীষণ রোগা পটকা আর লম্বা। সবিতা চুল আঁচড়ান। তার চুল রিবন্ডিং করা এবং খুব পরিপাটি হয়ে আসেন। উনি খুব ছোট ছোট স্কার্ট পরেন। সেখান থেকে তার শুকনো কাল পা বেরিয়ে থাকে। মিটিং এ অনেক প্রশ্ন করেন সবিতা। তার প্রশ্ন শুনে মনে হয় প্রেজেন্টেশন এর পুরোটা সে একাই বুঝেছে। এ তিনজন প্রফেসর আর স্টুডেন্ট ছাড়াও আমাদের ল্যাবে অনেক ইমপ্লয়ি কাজ করেন। মারকোট নামে একটি থাই মেয়ে কাজ করে। ভীষণ ভাল মেয়েটি। তবে সে সারাক্ষণ ল্যারির গা ঘেঁষে বসে। ল্যারি ইমেজিং ইঞ্জিনিয়ারিং। তাকে আমার খুব ভয় লাগে। তার কথাও আমি কিছু বুঝতে পারি না। শুধু হু হু করি। মিটিং এর মধ্যে ডক্টর হেলডার একবার বাইরে যায়। ফরাসী ছেলেটা নাম রোমান, ডক্টর হেলডারের ল্যাপটপে কিছু একটা করে। হেলডার ফিরলে সবাই খুব হাসাহাসি করে। শুধু হেলডার হাসে না, তিনি বলেন, ও রোমান তুমি কি আমাকে পাগল করে দিবে, আমাকে আবার ডোনাট আনতে হবে ।

এতক্ষণ আমি কিছুই বুঝিনি। না বুঝেই হাসতে থাকি। ল্যাবে আসলে সুদীপকে জিজ্ঞেস করি। সুদীপ বলে, একজন দায়িত্ববান গবেষকের কাজ নিজের গবেষণা যাতে চুরি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। তুমি খুব কষ্ট করে দু বছর ধরে কিছু একটা করলে আর তোমার কম্পিঊটার থেকে এক মিনিটে কেঊ সেটা নিয়ে নিজের বলে চালিয়ে দেবে। আর তুমি প্রমাণও করতে পারবে না। তাই সবসময় কম্পিউটার লক রাখবে। আর ভুলে গেলে তোমার একাঊণ্টে অন্য কেউ ঢুকে সবাইকে ম্যাসেজ পাঠাবে, হাই আমি জান্নাতুন, অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি আগামী মিটিং এ আমি তোমাদের জন্য ডোনাট আনছি। তুমি নিশ্চয়ই চাও না, গাঁটের পয়সা খরচ করে সবাইকে ডোনাট খাওয়াতে আর তোমার অসাবধানতার কথা সবাইকে জানাতে। আমি বললাম, আমি চাই না।

চাই না বললেও প্রথম মাসে আমাকে তিনবার গাঁটের টাকা খরচ করতে হল। টাকা পয়সায় খুব টানাটানি অবস্থা আমার। ডোনাট কিনতে কিনতে নাজেহাল। নাসরিন আমাকে বললো, ডোনাট বানিয়ে নিয়ে যেতে হবে এমন কথা নেই। তুই কেক নিয়ে যা। নাসরিন বিভিন্ন রকম কেক বানায়। গাজর, কলা, আনারস কোনটাই সে বাদ দেয় না। আমাকে নারকেলের কেক বানিয়ে দেওয়া হল। কেক পেয়ে সবাই ভীষণ খুশী হয়। কয়েকবার ডোনাট এনে আমি বেশ বিরক্ত। এবার আমিও প্রতিশোধ নেই। যারা আমাকে ইমেইল পাঠিয়েছে, তক্কে তক্কে থাকি তাদের কম্পিউটার কবে আনলক পাব। কিন্তু পাই না। এই নিয়ে ল্যাবে খুব মজা হয়। কাউকে ধরলেই অন্যরা খুশী। নেক্সট মিটিং এই ডোনাট। আর একটি মজা ছিল ফ্লাইং মানকি। কেঊ অন্যমনস্ক থাকলে তার গায়ে ছোঁড়া হবে আর তখনি মানকিটা বিকট চিৎকার দিবে। সাথে সাথে সেই বেচারিতো ভয়ে শেষ।

ল্যাবে থাকতে ভালই লাগত আমার। একঘেয়েমি ব্যাপারটা ছিল না। আমি দু’বেলার খাবার নিয়ে যেতাম। ল্যাবের ফ্রিজে রাখতাম। দুপুরে ওভেনে গরম করে খেতাম। আর একটি খেতাম সন্ধ্যায়। আমাদের ফ্লোরে একটা কিচেন ছিল। ওখানেই থালাবাসন ধুতাম। ঘুম ঘুম লাগলে কফি বানাতাম। নেপালি ছেলেগুলো ঠাণ্ডার কারণে অনেকদিন বাইরে যেত না। ওরা ল্যাবেই ইনস্ট্যান্ট নুডুলস সিদ্ধ করে খেয়ে ফেলত। কিচেনটাকে লাঞ্চ রুম বলা হত। সেখানে আমার প্রায়ই সানসানের সাথে দেখা হত। সানসান চাইনিজ, বেশ স্বাস্থ্যবান মেয়েটি। চাইনিজরা সাধারণত পাটকাঠির মত হয়। সানসান সেরকম ছিল না, চেহারাতেও বেশ কোমলতা। ওর সাথে খুব গল্প হত। ওদের দেশের খাবার আমাদের দেশের সবাই খুব পছন্দ করে জেনে খুব খুশি হল। আমাকে ওর সাথে লাঞ্চ করতে অনুরোধ করল। লাঞ্চে সে শুকরের মাংস এনেছে। আমি বললাম গরু ছাগল ছাড়া আমি খাই না। ওর কাছ থেকে জানলাম চায়নাতে সবাই শুকর খায়। গরু খুব দামী জিনিস। সাধারণত হাল চাষে ব্যবহার করা হয়।

এর মাঝে আমরা রুমমেট জোগাড় করার চেষ্টা করছিলাম। একটি কানাডিয়ান মেয়ে আমাদের বাসা নিতে রাজি হয়। সে আমাদেরকে ২০০০ ডলারের চেক পাঠায়। যেটা মূল ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি। আমরা বেশ অবাক হই। আমাদেরকে এত বিশ্বাস করে জেনে খুব ভাল লাগে। মেয়েটি প্রায়ই নাসরিনকে ইমেইল করে। নাসরিনের সাথে তার খাতির হয়। তারপর সে তার নানা অসুবিধার কথা লিখে জানায়। তার মালপত্র সে কানাডা থেকে পাঠিয়েছে। ওয়াশিংটনে আটকা পড়ে আছে। সে কি একটা কাজের জন্য যেতে পারছে না। মালপত্র ছাড়ানোর জন্য সে এক ব্যক্তির একাউন্টে কিছু টাকা পাঠাতে বলে। আমরা তো ২০০০ ডলার এর চেক পেয়েই গেছি। আমি নাসরিনকে বলি ২০০ ডলার পাঠিয়ে দিতে। বিপদে একটি মেয়েকে আমাদের অবশ্যই সাহায্য করা উচিৎ। নাসরিন বলে, ঠিক আছে। আগে টাকাটা ভাঙ্গাই। তারপর ওর টাকা দিয়ে ওকেই সাহায্য করি । আমরা ব্যাংকের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি। ব্যাংক কর্মকর্তারা আমাদের জেরা করছেন, আমরা এই বাউন্স চেক কোথায় পেয়েছি। নাসরিন খুব রেগে যায়। মেয়েটিকে বাংলায় গালি দিয়ে ইমেইল করে এবং নাসরিন বুঝতে পারে মেয়েটি আসলে ছেলে ছিল।

আমি ল্যাবে খুব মনোযোগ দিয়ে কাজকর্ম করার চেষ্টা করি। ক্লাসের সময়টুকু ছাড়া আমি ল্যাবে থাকি। রোমান সবসময় ল্যাবে থাকে। ও আমার এক বছর আগে এসেছে। কোর্সওয়ার্ক শেষ করে ফেলেছে। রোমান সি এস ইর। ও ডাটাবেস নিয়ে কাজ করে। ওকে আমার খুব বুদ্ধিমান মনে হয়। সবাই ওর কাছে সমস্যা নিয়ে যায়। ও যেকোনো প্রবলেম সল্ভ করে ফেলে। সবাই ওকে খুব পছন্দ করে। আমার আর রোমানের ডেস্ক একটু দূরে কোনাকুনি। আমার স্ক্রিন সে দেখতে পায়। আমি ওর সামনে। তাই ওকে দেখতে পাই না। তবু মাঝে মাঝে মনে হয় কেউ একজন আমাকে দেখছে। ঘুরে দেখি ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ল্যাবের অন্য ছেলেগুলো ভীষণ ভাল। ওরা সবসময় আমার কাছে আসে। আমি কি বুঝতে পারছিনা জানতে চায়, না বুঝতে চাইলেও জোর করে বুঝিয়ে দেয়। ওদের ভালবাসায় হাঁপিয়ে উঠি। আমেরিকানগুলো এরকম করেনা। রোমানও এরকম করে না। ও শুধু তাকিয়ে থাকে।

এর মাঝে অনেকগুলা নাইট হয়ে গেছে। আমি ইন্ডিয়ান নাইটে সবুজ জামদানি পরে যাই। ঐদিন সাজ্জাদের সাথে আমাদের মন কষাকষি হয়। আমরা আর সাজ্জাদের গাড়িতে না ওঠার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু সাজ্জাদকে বুঝতে দেই না। তবে সাজ্জাদ আন্দাজ করতে পারে। আমরা প্রোগ্রামে গেছি। অনেক দূরে দেখি রোমান বসে আছে। আমরা বাসায় ফিরব, বেরুচ্ছি। কেউ একজন আমাকে ডাকছে। দেখি, রোমান। আমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে সে জানায়। আমি থ্যাংক ইউ বলে বাসায় চলে আসি। রোমানের সাথে আমার কথা শুরু হয়। আমি ম্যাটল্যাব এ নতুন নতুন কাজ করছি। কোন ভুল দেখলেই রোমান ছুটে আসে। আমি লজ্জা পাই সামান্য বিষয় পারি না বলে। ও লজ্জা পায় না। আমার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে। ওর তাকানোর মাত্রা বাড়ে। আমাকে দেখলেই হাসে। এখন সে প্রায়ই আমার সাথে ব্যক্তিগত আলাপ করে। আমার ধর্ম জানতে চায়। আমার দেশের গল্প, আমার ইচ্ছের গল্প শুনতে চায়। আমি ওকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশটার গল্প বলি। সেই দেশের সরল মানুষগুলোর গল্প বলি। সরল মানুষগুলোর অনুভূতির গল্প বলি। সেও নিজের গল্প বলে। তার ছেলেবেলার গল্প বলে। ও একজন এথিস্ট। ওরা দুই ভাই। ওর বাবা কসাই। ওর বাবা–মা এখনও বিয়ে করেনি। ওদের বাসার ছবি দেখায়, বেশ বড় বাড়ি ওদের। সুন্দর গাড়ি দেখি। ওর বাবা–মার ছবি দেখি। জীবনে প্রথম কোন সুট টাই পরা কসাই দেখি আমি। ওদেরকে আমার বেশ ধনী পরিবার মনে হয়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, ফ্রান্স তো প্রথম সারির দেশ, খুব ভাল রিসার্চ হয়, তবু কেন এখানে আসলে? ও বলে, জাস্ট ফর ফান, মজা করার জন্য আমেরিকা উত্তম জায়গা।

রোমান একটা ফ্রেন্স খাবার বানায়। সেটা নিয়ে প্রায় ল্যাবে আসে। খাবারটির নাম ক্রেপ। খুব মজার খাবার। রুটির ভিতর চকলেট দেওয়া। অনেকটা পাটিসাপটার মত। তবে রুটিটাই মজা। ডিম দিয়ে ফারমেন্ট করে বানানো। ভীষণ ভাল লাগে আমার। ক্রেপ খেয়ে আমি নবউদ্যমে কাজ করি। সুদীপ বলে তুমি কি জানো এতে কিছুটা ওয়াইন ছিল। এরপরই আমার মাথা ঝিম ঝিম করে। রোমানকে আমি রেসিপি জিজ্ঞেস করি। সে আমাকে তার বাসায় আমন্ত্রণ জানায় রান্না শেখার জন্য। ওর আমন্ত্রণে আমি ভীষণ ঘাবড়ে যাই। আমি না বলি। ও আমাকে আর নাসরিনকে একদিন ওয়ালমার্টে রাইড দেয়। আমরা এখন ওয়ালমার্ট হেঁটে হেঁটেই যাই। বাসার ভিতর থেকে দেখে মনে হয় ভীষণ সানি ডে। নিশ্চয় বাইরে গরম, জ্যাকেট ছাড়াই হাঁটা যাবে। তাপমাত্রা আসলে তখন মাইনাস বিশের কাছে পৌঁছে গেছে। বাসা থেকে বেরুবার আগে সবাই ওয়েদার চেক করে বেরোয়। ক্লাস শেষে সন্ধ্যায় আমি আর নাসরিন বেরিয়ে পড়ি। মুখ চোখ ঢেকে হাঁটি। হাঁটার সময় চোখ–নাক দিয়ে পানি পড়ে। এক সময় জমে যায় পানি । দু মাইলের রাস্তা পথে বিভিন্ন জায়গায় আমরা থামি। একটা পার্লার পড়ে রাস্তায়। আমরা সেখানে যাই। বিভিন্ন সমস্যার কথা বলি। তারপর বলি, এই সার্ভিসটা নিব কিনা ভেবে পরে জানাব। আমরা কখনও সার্ভিস নেই না। আসার সময় ফ্রি কফি খেয়ে আসি। ফ্রি কফি খাওয়ার জন্য নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করি। এ নিয়ে খুব মজা হয়। নাসরিন সব সিদ্ধান্ত নেয়। গল্প সাজায়। আমি ওর সাথে সাথে থাকি। দু মাইল হেঁটে আমরা সুপার স্টোর ওয়ালমার্ট যাই।

আমরা সব জামাকাপড় দেখি, ছোট ছোট জামা পরে ট্রায়াল দেই। কোনটা কিনি না। এসব করতে করতে প্রায় বারোটার মত বেজে যায়। প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আমরা বাসার দিকে রওনা দেই। নাসরিন চেক করে আমার গলার মাফলার ঠিক আছে কিনা। নাসরিনের পিঠে সমস্যা। আমি পিঠে বাজার নেই। আমরা বাড়ির পথে হাঁটি। পথে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমরা থামি, একটু বিশ্রাম নেই। আবার হাঁটি। পথে অনেকগুলো ছেলে আমাদের দেখে গাড়ি থামায়, আমরা তাদের সাথে কফি খেতে চাই কিনা জানতে চায়। আমরা ভয়ে পেয়ে যাই। জোরে হেঁটে চলে আসি।

আমরা এখন সবসময় হাঁটি। আজ কেউ হাঁটছে না, আমি একা হাঁটছি। কাল ব্লিযার্ড (তুষার ঝড়) হয়েছে। গত তের বছরে এরকম ঝড় হয়নি। পুরা শহর বরফে ঢেকে গেছে। রাস্তায় কেউ নেই। পুরা শহরটা মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছে। আমি হাঁটছি। লাইব্রেরীতে পড়তে গেছি। এর আগে লাইব্রেরির স্টাডিতে আসিনি। নিরিবিলিতে পড়তে আমি উপরতলায় যাই। বিশাল লাইব্রেরী। সবাই সোফার উপর পা তুলে বসে পড়ছে। কেউ শুয়ে পড়ছে। পড়ার জন্য ছোট কিউবিকলও আছে। আবার আলাদা রুম আছে। পুরোদিনের জন্য একটা রুম রিজার্ভও করা যায়। আমি কয়েকদিন খুব লাইব্রেরীতে পড়তে যাই। তারপর আমার মনে হয় আমার পড়ালেখা হচ্ছে না লাইব্রেরীতে। আমি সোফার উপর শুধু পা তুলে বসেই থাকি আর লাইব্রেরি দেখে মুগ্ধ হই। লেখাপড়া সেরকম হয় না। আর তাপমাত্রা এখন মাইনাস পঁচিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। লাইব্রেরি বেশ দূরে। হেঁটে আসতেও খুব কষ্ট হয়ে যায়। বাসায় এসে বিশাল বড় বেডরুমটায় আমার একা মনে হয়। কার্নিশের দরজা বেয়ে এখনি কেউ আসছে এরকম মনে হয়। আমি ডাইনিঙে ঘুমাই। কার্টেইন তুলে রেস্টুরেন্টের মানুষ দেখি। আমার আর একা একা মনে হয় না।

ইদানিং ঘুমাতে খুব অসুবিধে হয়। নাসরিন মধ্যরাতে নতুন নতুন ডিস রান্না করে। আমি ঘুমাতে পারি না। আমি বেড রুমে ঘুমাই। বাড়িয়ালা নতুন লক লাগিয়ে দিয়েছে। তবুও মনে হয় এখনি কেউ দরজা খুলে ফেলবে। আমি আতংক নিয়ে ঘুমাই। নাসরিনকে বলি আমার সাথে ঘুমাতে, ও রাজি হয় না। একদিন জানালার পাশে কিছু বিয়ারের ক্যান দেখি। কিন্তু কোথাও কাউকে দেখি না। আর একদিন খুব ভয় পেয়ে যাই। কার্নিশ থেকে অদ্ভুত শব্দ আসে। আমি নাসরিনকে ডাকি। নাসরিন আমাকে ধমক দেয়। শব্দটা আবার হয়। নাসরিনও ভয় পেয়ে যায়। আমরা ছুটে বাসার বাইরে আসি। সাজ্জাদকে বলি, সাজ্জাদ বলে পুলিশে ফোন করতে। আমরা আবার ৯১১ এ কল করি। পুলিশ আসে।  পুলিশ পুরোটা শোনে। সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখে। তারপর নিশ্চিত হয়। একটি কাঠবিড়ালি কার্নিশের কোন ফুটো দিয়ে ঢোকে আর বের হয়। এজন্য শব্দটা হয়। তারা আমাদেরকে বলে, বাড়িয়ালাকে বলে কার্নিশের ফুটো মেরামত করে নিতে।  পুলিশগুলো খুব ভাল ব্যবহার করে আমাদের সাথে। এরকম অকারণে পুলিশ ডাকার জন্য আমরা লজ্জিত হই। সাজ্জাদ বলে, লজ্জার কিছু নেই। এ দেশে বাথরুমে আটকা পড়লেও মানুষ পুলিশ ডাকে।

আমার ভয় এখন অনেকটা কেটে গেছে। তবুও আমি ল্যাবে থাকি। সব পড়া ল্যাবেই শেষ করি। রোমান ইদানিং আমার চারপাশে ভীষণ ঘুরঘুর করে। আর দূর থেকে সে আমাকে দেখে না। অন্য অনেকের নজরে পড়ে হয়ত বিষয়টা। সুদীপ এই নিয়ে আমাকে একদিন প্রশ্ন করে। আমি রোমানকে এড়িয়ে চলি, কখনও তার গাড়িতে উঠিনা। সে ডিনারের আমন্ত্রণ জানায়, যাই না। খুব কম কথা বলি। কিন্তু কিন্তু ভিতরে ভিতরে বেশ অস্থির লাগে। আমি নাসরিনকে অস্থিরতার কথা বলি। নাসরিন আমাকে কষে একটা থাপ্পড় দিতে চায়। বলে, শেষ পর্যন্ত একটা সাদা বান্দরকে ভাল লাগল তোর। তুই ভাবছিস ঐ ছেলে  তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ও আসলে এরকম আরও একশজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। তবু আমার মনে হয়, রোমান ভাল ছেলে, নাসরিনের কথা ঠিক মনে হয় না। ও নিশ্চয়ই আমাকে ভালবাসে। তা না হলে কেন এত ঘুর ঘুর করে। আমার তালগোল লাগে সবকিছু। নিজের চিন্তা ভাবনার জন্য ভীষণ অনুশোচনা হয়। রোমানকে ভুলতে আমি আব্বু–আম্মুকে ফোন করি। বাংলাদেশি নাইটের কথা বলি। আম্মু আমার গল্প শোনে, বলে ভাল। আব্বু খুব রেগে যায়। আমি ময়না ছলাৎ ছলাৎ নাচের সিদ্ধান্ত বাতিল করি। আমার সিদ্ধান্ত জেনে নাসরিন ভীষণ রেগে যায়। নানা কারণে আমাদের বাংলাদেশি নাইটের প্রোগ্রাম বাতিল হয়।

সামার এগিয়ে আসছে। বরফ গলতে শুরু করছে। চারদিকে প্যাচপ্যাচে হয়ে গেছে। হাঁটলে আমার জুতো ভিজে যায়। নাসরিন বলে, তুই একটা স্নোবুট কিনে ফেল। এখন বেশ দাম কম। কিন্তু আমার মনে হয়, এইতো সামার এসে গেছে। কিন্তু সামার আসে না। ভয়াবহ ভাবে আবার স্নো পড়তে থাকে। সাজ্জাদের সাথে আর বেশি কথা হয় না আমার। আশিক, কামরানের সাথেও না। নাসরিন সাজ্জাদ, কামরান আর আশিকের সাথে ঘুরতে যায়। আমি যাই না বলে ওরা আমাকে আর বলেও না। একদিন ওদের সাথে সিনেমা দেখতে যাই। একটুও ভাল লাগে না সিনেমা আমার। আমি ওদের থেকে যেন অনেকটা আলাদা হয়ে যায়। ওরা অনেক দাওয়াতে যায়। আমি কোথাও যাই না।

নাসির ভাই চলে যাচ্ছে। ওনার চাকরি হয়েছে। কালই যাবে। সবাই ওনার বাসায় ভীড় করে ওনার ফার্নিচার নেবার জন্য। নাসরিনও যায়। যাবার আগে আমাকে বলে না। আমার খুব মন খারাপ থাকে সেদিন। খুব কান্নাকাটি করি। নাসরিন বাসায় এসে কিছু আঁচ করে। সাজ্জাদ ও এসেছে। সাজ্জাদ বলে, কি তন্দ্রা তোমার পড়ার টেবিল নেই। দেখ তোমার জন্য টেবিল এনেছি। খাওয়া দাওয়া করা যাবে আবার পড়তেও পারবে। টেবিলটা ওরা নাসির ভাইয়ের বাসা থেকে এনেছে, সাথে দুটো চেয়ারও এনেছে। চেয়ারে বসে নাসরিন পড়ে, আমি মাঝে মাঝে বসি। কামরান এসে একদিন বসে। চেয়ারটা ভেঙ্গে যায়। নাসরিন কামরানকে খুব বকে। বলে চেয়ার ঠিক করে না দেওয়া পর্যন্ত বাড়ি যেতে দেওয়া হবে না। কামরান খুব চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। খুব খারাপভাবে ভেঙেছে চেয়ারটা। কামরান খুব লজ্জা পায়। নাসরিন খুব হাসাহাসি করে। কামরানকে কম খাওয়ার পরামর্শ দেয়। পরামর্শ নিয়ে কামরান বাসায় যায়। নাসির ভাই চলে যাওয়ায় সবার বেশ মন খারাপ হয়। সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হয় সাজ্জাদ আর আশিকের। আমারও খুব মন খারাপ থাকে।

এপ্রিল মাস চলে এসেছে। একদিন বাসায় ফিরে দেখি বাসায় পার্টি। নাসরিন ইলিশ করেছে। অনেক বিদেশী বন্ধুদের দাওয়াত দিয়েছে। আমার খুব বিরক্ত লাগে। ভাল লাগে না মানুষজন। হাতের টাকা ফুরিয়ে আসছে ভীষণ চিন্তা হতে থাকে টাকার জন্য। তবুও হাসি হাসি মুখ করে থাকি। খাবার আগে নাসরিন ইলিশ মাছ নিয়ে একটা বক্তৃতা দেয়। বক্তৃতায় সে বলে, ইলিশ একটি সুস্বাদু ও সুগন্ধি মাছ। এই মাছ কোন বাড়িতে রান্না হলে পুরো এলাকায় সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। আর খাবার পর হাত ভাল করে ধুলেও তিনদিন পর্যন্ত গন্ধ থাকে এবং এটি বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না । ওরা খুব উৎসুক হয়ে মাছ খায়। ওদের চোখ মুখ দেখে মনে হয় ভাল লাগেনি। আমারও ভাল লাগে না। আমার কাছে পুঁটির থেকেও খারাপ লাগে। তারপর নাসরিন বলে সব ইন্ডিয়ান স্টোরের দোষ। পঁচা মাছ দিয়ে উনত্রিশ ডলার নিয়েছে।

আমার আর কোথাও যেতে ভাল লাগে না এখন। ল্যাবে খুব কম যাই আমি। আর দুসপ্তাহ পর ফাইনাল। কোর্স নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকি। প্রফেসর কিছু বলে না এ নিয়ে। বাসায় কাজ করি। প্রজেক্ট নিয়েও খুব ব্যস্ত। তবে মিটিংগুলোতে যাই। রোমান আর আমার সাথে চোখাচোখি করে না। খুব অবাক হই।

ফাইনাল উইকের আগের দিন আমি রোমানকে একটি আমেরিকান মেয়ের সাথে দেখি।

 


প্রবাসে সিরিজের গল্পসমূহঃ

 পর্ব ১ঃ যাত্রাপথের গল্প
 পর্ব ২ঃ নতুন বাসা, ওরিয়েন্টেশন, রাস্তা হারানো
 পর্ব ৩ঃ পুলিশ আসা, রেজিস্ট্রেশন বিড়ম্বনা
 পর্ব ৪ঃ ডরমেটরির গল্প, প্রথম তুষারপাত
 পর্ব ৫ঃ ইন্টারন্যাশনাল নাইট, বাসা নিয়ে ঝামেলা, শায়লা আপুর চলে যাওয়া
 পর্ব ৬ঃ কামরানকে হাসপাতালে নেওয়া, টেকো সুদীপ আর ব্রিটিশ প্রফেসরের গল্প
 পর্ব ৭ঃ ল্যাব ও ফরাসী যুবকের হৃদয় ভাঙার গল্প
 পর্ব ৮ঃ সামার এসেছে, বেতন পাইনি, প্রথম বাসা ছেড়ে দিলাম
 পর্ব ৯ঃ সঙ্গীহীন জীবন, সুরিয়া মথুর গল্প, সামারের দিনলিপি, একা পথ চলা
 পর্ব ১০ঃ বিদেশী ভাষা শেখা ও আমেরিকান চাষাবাদের গল্প
 পর্ব ১১ঃ আমার বাইবেল শেখা
 পর্ব ১২ঃ সাজ্জাদের চলে যাওয়া, লিবিয়ান পরিবারের গল্প
 পর্ব ১৩ঃ মুহিত ভাইয়ের গল্প, আমার আগুন ধরিয়ে ফেলা
 পর্ব ১৪ঃ মসজিদ, ঈদ, ইয়ামিনী আসা, নতুন বাসা, আমেরিকান বিয়ে ও অরিগন যাবার গল্প
 পর্ব ১৫ঃ
 পর্ব ১৬ঃ
 পর্ব ১৭ঃ
 পর্ব ১৮ঃ
 পর্ব ১৯ঃ

লেখক পরিচিতিঃ

 জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ ক্যারোলিনা এ এন্ড টি স্টেট’ ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ‘PhD’ করছেন এবং তার গবেষণার বিষয় হল ‘Real time Object detection with Higher Accuracy’। jannatunজান্নাতুন নাহার তন্দ্রার স্কুল জীবন কেটেছে চুয়াডাঙ্গা শহরে, কলেজ জীবন হলিক্রস কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। এবং সেখান থেকেই ২০১০ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষে ২০১২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং ২০১৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা অবসরে লিখতে ভালবাসেন এবং সে অভ্যাস বশতই আমেরিকার গ্রাজুয়েট প্রোগামে একা একটি মেয়ে পড়তে আসার অভিজ্ঞতা (সাউথ ডাকোটা) একসময় তিনি লিখতে শুরু করেন। এবং তার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘প্রবাসে’ নামে ২০১৫ সালের ‘একুশে বই মেলায়’ তার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি কোন তথ্যমূলক বই নয় বরং বলা যায় এটি লেখিকার রোজকার ডায়েরী।