সুরিয়ার বাসায় আমি একা উঠছি। কিন্তু আমার সাথে দুজনের জিনিস। আমার আর নাসরিনের। তাই ওঠার আগের দিন, নাসরিনের কিছু জিনিস আমি কাউসার ভাইয়ের বাসায় রাখি। শরিফ ভাই আর কাউসার ভাই ওনারা দুজন একসাথে থাকেন। যদিও বাসাটা একজনের নামে নেওয়া। বাড়ির ম্যানেজার জানেন কাউসার ভাই একা থাকেন। প্রতি মাসে ম্যানেজার একবার ইন্সপেকশনে আসেন। তবে আসার আগে বলে আসেন। আমেরিকানরা হুট করে কারো বাসায় আসে না। আসার আগে এপয়েন্টমেন্ট করে আসে। ইন্সপেকশনের দিন কাউসার ভাই শরীফ ভাইয়ের জিনিস লুকিয়ে রাখে। এমনভাবে সাজিয়ে রাখে যেন সে একাই থাকে। ইন্সপেকশন হয়ে গেলে আবার নতুন করে সাজায়। সাজ্জাদ আর কামরানেরও একই অবস্থা। দুই রুমের বাসা। কিন্তু একজন নিয়েছে বাসাটা। তাই নিয়ম অনুযায়ী অন্যের থাকার অনুমতি নেই। ধরা পড়লে বাসা ছেড়ে দিতে হয়। সাথে অনেক জরিমানাও গুনতে হয়।
অন্য কিছুর সাথে তুলনা করলে আমেরিকাতে খাবার দাবার বেশ সস্তা। তবে বাসা ভাড়াটা খুব বেশী। ইন্ডিয়ানরা অনেকজন এক বাসায় গাদাগাদি করে থাকে। এতে ভাড়া অনেক বাঁচে। আর ইন্সপেকশনের দিন সিস্টেম করে ফেলে। বাঙালিরা খুব ভীতু। এরা এত সিস্টেম করার সাহস পায় না। সিস্টেম করলে অল্প সল্প করে।
ইন্ডিয়ানদের সাহস খুব মারাত্মক। এখানে সব কিছুতে ইন্স্যুরেন্স থাকে। ইন্ডিয়ানরা আই ফোন কেনে। কেনার কয়েক মাস পর কোম্পানিকে চিঠি লেখে। বলে ফোনটি হারিয়ে ফেলেছে। কোম্পানি এদেরকে নতুন ফোন দেয়। এরা আবার হারিয়ে ফেলে। কোম্পানি আবার ফোন দেয়। এভাবে একজন মানুষ দুতিনবার ফোন হারিয়ে ফেলে।
আমেরিকা তদন্তে বেশ ভাল। তবে এক্ষেত্রে এরা কিছু করতে পারে না। কারণ সিম ফেলে দিয়ে ফোন ততক্ষণে ইন্ডিয়া পৌঁছে গেছে। প্রথম প্রথম যখন শুনি, ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হয়নি। সুরিয়া আমাকে বিশ্বাস করতে সাহায্য করে। সে তার আই ফোনটির জন্য ক্লেইম করে। নতুন ফোন পায়। আর পুরনোটি তার বাবাকে ইন্ডিয়াতে পাঠিয়ে দেয়।
সুরিয়া খুব শান্ত আর ভীষণ ভাল একটি মেয়ে। সুরিয়ার এরকম আচরণ খুব অদ্ভুত লাগে আমার কাছে। ওকে জিজ্ঞেস করি, এটি তো অন্যায়, কেন করলে। সুরিয়া পরিসংখ্যান নিয়ে বসে। রাম, শ্যাম, গনেশ কার্তিক সবাই তো করে। আমি কেন করব না। সুরিয়া ভাবে একটি অন্যায় সবাই করলে তা আর তখন অন্যায় থাকে না। তবে এখানে অনেক ভীতু ইন্ডিয়ানও থাকে। বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া নিয়ে অনেক কারণে ইন্ডিয়ার উপর আমার খুব রাগ। তবে এখানে কোন রাগারাগি নেই। এখানে ওদেরকে আমার ভালই লাগে। পাশের বাড়ির লোক মনে হয়। ওরাও আমাদের সাথে খুব ভাল আচরণ করে। বিভিন্ন সমস্যায় এগিয়ে আসে।
কাউসার ভাইয়ের বাড়িতে জিনিস রাখতে আমি কাউসার ভাইকেই ডাকি। কাউসার ভাই আর শরীফ ভাই দুজনই আমার ক্যাম্পাসের। আমার থেকে তিন বছরের সিনিয়র। আমরা একই ডিপার্টমেন্টে পড়ি। তবে কাউসার ভাইয়ের সাথেই আমার বেশি কথা হয়। উনি আমাকে বেশ স্নেহ করেন। অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করি। কাউসার ভাই খুব আঁতেল আর পাঙ্কচুয়াল মানুষ। উনি ঠিক সময়ে আসেন। তবে জিনিসপত্র টানাটানির সময় আমাকেও ধরতে বলেন। বলেন, আমি একা এত ভারী জিনিস টানতে পারব না। একটা ছেলের মুখে এই কথা শুনে কিছুটা বিরক্ত হই আমি। তবে বিরক্তি চেপে রাখি। হাসিহাসি মুখে টানাটানি করি। আমার তখন মনে হয়, কাউসার ভাই আমার উপর আমেরিকান নিয়ম খাটাচ্ছেন। এখানকার মেয়েরা নিজেরাই সব করে। ছেলেদের একেবারেই ধার ধারে না। মেয়েগুলোর শক্তিও সেরকম।
শায়লা আপু চলে যাবার সময় আমরা ভুলে অন্য একটা বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। আমাদের হাতে সময়ও ছিল না। এক আমেরিকান অচেনা মহিলা শায়লা আপুকে রাইড দিল। শায়লা আপুর ভারী ব্যাগ নিমিষেই তুলে ফেলল। আমেরিকান মেয়েদের শক্তির কথা নাসির ভাইয়ের কাছেও শুনেছি। নাসির ভাই একবার সামারে ক্যাম্পাসে কাজ নিয়েছিলেন। কাজটা ছিল, ক্যাম্পাসের বিল্ডিঙে রঙের কাজ হচ্ছে। তাকে ঘষে ঘষে পুরনো দরজার রঙ তুলতে হবে। নাসির ভাই ভারী দরজা তুলতে পারতেন না। হাই স্কুলের মেয়ে এসে দরজা তুলে গট গট করে হেঁটে চলে যেত। নাসির ভাই নাকি ঐ সময়টা কাজকাম কিছুই করেন নি। উনি পুরোটা সময় ঘুমাতেন। আর বিকেলে কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার সময় বলতেন, আগের রঙটা ভীষণ বাজে। দেখ এত ঘষেও তোলা যায়নি। আমেরিকানরা সাধারনত ভদ্র গোছের। আর এখানেও হয়ত সরকারী কাজে ঢিলে ঢালা। তাই নাসির ভাইকে কেউ কিছু বলত না। নাসির ভাই ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই অনেক বেতন তুলে ফেললেন। আমার তখন মনে হল, কাউসার ভাই এই কারণেই টানাটানি করতে চান না, আমেরিকান নিয়ম অনুসরণ করতে চান। এর আগেও ব্যাপারটা খেয়াল করেছি। আমরা সিনেমা দেখতে গিয়েছি। কাউসার ভাই ই আমাদেরকে ডেকে নিয়ে গেলেন। টিকেট কাটার সময় শুধু নিজেরটা কেটে গটগট করে হাঁটা দিলেন। একটা সৌজন্যমূলক জিজ্ঞেসও করলেন না, পে করতে হবে কিনা। অথচ বাংলাদেশে দেখেছি মেয়েদের বিল দিয়ে দিতে চাওয়া খুব সাধারণ ভদ্রতা। আর উনি বললেই, আমরা নিশ্চয়ই রাজী হয়ে যেতাম না।
সাজ্জাদের গাড়ির উপর খুব রাগ থাকলেও সাজাদের উপর অত রাগ ছিল না। আমরা সব কথা সাজ্জাদের সাথে শেয়ার করতাম। সাজ্জাদ বললো এ রকম কোন নিয়ম এখানে নেই। এখানে কেউ কারো জন্য পে করে না। একবার সাজ্জাদকে এক আমেরিকান ছেলে বললো, সাজ্জাদ তার সাথে লাঞ্চে যাবে কিনা। গেলে তার খুব ভাল লাগবে। তার খুব ইচ্ছা সাজ্জাদকে নিয়ে ভাল একটা রেস্টুরেন্টে সে খাবে একদিন। এরকম বিনে পয়সার অফার সাজ্জাদ সাথে সাথে লুফে নিল। ইচ্ছামত খেল। তারপর দেখে পাহাড় সমান বিল। সাজ্জাদের বিল সাজ্জাদকেই পে করতে হলো। এখানে সবাই সবাইকে একসাথে যাওয়ার খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে। কিন্তু নিমন্ত্রণে অংশগ্রহণ করলে যার বিল তাকেই পরিশোধ করতে হবে। এটাই আমেরিকান নিয়ম। তবে সাজ্জাদের কাছে পরে শুনেছি কাউসার ভাইয়ের হাতে সমস্যা। একবার ক্রিকেট খেলতে যেয়ে হাত ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। তারপর থেকে হাতে স্থায়ী সমস্যা হয়ে গেছে।
সুরিয়ার বাসায় যেদিন উঠি, সেদিন আমার একজনের সাহায্য দরকার। জিনিসপত্র টানাটানি করতে হবে আর আমাকে রাইড দিতে হবে। সেদিন কাউসার ভাইকে আমি ডাকিনা। সাজ্জাদের উপর তখন তো ভীষণ অভিমান। তাই তাকেও ডাকার প্রশ্ন আসে না। ঐ দিন শরীফ ভাই আমাকে রাইড দিলেন। শরীফ ভাইয়ের গাড়ির একটা ডোর। পিছনের দিকে দরজা নেই। সামনের সিটগুলো শুইয়ে দিয়ে পিছনে জিনিস রাখতে হয়। শরিফ ভাই লোকটাকে আমি আগে খুব খারাপ ভাবতাম। সবসময় রাগী রাগী চোখে তাকায়। মেয়েদের সাথে বিশেষ কথা বলে না। তাকে যতবার দেখেছি, সবসময় সিগারেট খাচ্ছে। সাজ্জাদ বলেছে উনি বিয়ারও খান। একদিন উনাকে আমি বিয়ার খাওয়া অবস্থায় সাজ্জাদের বাসার সামনে দেখি। আমাকে দেখে উনি বিয়ার লুকিয়ে ফেললেন না। খেতে খেতেই বললেন, কেমন আছো?
এই সামারে কাউসার ভাই, শরীফ ভাই কারো ফান্ডিং নেই। কাউসার ভাই খুব পরিশ্রমী ছেলে। তবু কেন জানি তিনি ফান্ড জোগাড় করতে পারেননি। তবে তিনি কাজ কর্ম জোগাড় করার ভীষণ চেষ্টা করছেন আর শরিফ ভাই কিছুই করছেন না। বসে বসে পা দোলাচ্ছেন, দুপুর পর্যন্ত ঘুমাচ্ছেন। সিগারেট দিয়ে সকালের নাস্তা দুপুরে সারছেন। আর বিকেলে ইন্ডিয়ানদের সাথে ক্রিকেট খেলছেন। এখানে ছেলেরা খুব ক্রিকেট খেলে। প্রচণ্ড তুষারপাতের সময়ও খেলে। তখন ইনডোর মাঠে খেলে। বাঙালীদের মধ্যে শরিফ ভাই, সাজ্জাদ, আশিক আর সৌরভ ভাই খেলেন।
সৌরভ ভাই হলেন রুমা আপুর হাসবেন্ড। উনি এখানে থাকেন না। নর্থ ডাকোটাতে পড়েন। মাসে কয়েকবার আসেন রুমা আপুকে দেখতে। যদিও আপুর অভিযোগ এ সময়টাও তাকে পাওয়া যায় না। ক্রিকেট খেলতেই সে এখানে আসে। কিছুদিন পর পর এদের ম্যাচ লেগে থাকে। আড্ডা টাড্ডা সবজায়গায় এদের ক্রিকেটের গল্প। ক্রিকেটের জন্য অনেকসময় তারা দাওয়াতও মিস করে। ব্যাচেলররা সাধারণত কোন বাসার দাওয়াত মিস করে না। কেউ দাওয়াত দিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আগে থেকে গিয়ে বসে থাকে। কিন্তু ক্রিকেট খেলা থাকলে ভিন্ন। তাদের দেখা পাওয়া যায় না। অনেকসময় দাওয়াতকারি তাদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দেয়।
এখানকার আড্ডাগুলো বেশ রাত পর্যন্ত চলে। আড্ডার বিষয়বস্তু দেশ। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবাই খুব চিন্তিত। সবারই দেশে ফিরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দেশে ফেরার কথা ভাবলেই কিসের যেন অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরে। যেই ভাবী দাওয়াত করেন, তিনি অবশ্য চিন্তা করেন অন্য কিছু নিয়ে। খাবারে কম পড়বে কিনা এই নিয়ে। এখানে সব বুফে সিস্টেমে খাবার দেওয়া হয়। সবাই গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে খায়। আমি একটু খাবার দাবার বেছে খাই। মুটিয়ে যাওয়ার ভয়ে কম খাই। তবে ঐদিন আমিও নিয়ম মানি না। যতটা পারি খেয়ে নিই। কারণ এ জিনিস তো আর কোথাও পাওয়া যাবে না। এখানে সবার রান্নাও খুব ভাল। সারা সপ্তাহ নিজের রান্না খেয়ে, যাই খাই অমৃত লাগে। মেয়েরা সাধারণত আগে খাবার নেয়। কারণ ছেলেরা আগে নিলে সব খাবার সাবাড় হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। হয়ত আমরা গল্পে মশগুল। তখন ক্রিকেটাররা আসেন। খেতে খেতে তাদের আবার সেই ক্রিকেটের গল্প। এখানে আড্ডায় ছেলে মেয়েরা আলাদা বসে। মেয়েরা বসে ভেতরের ঘরে। তবে ভেতর থেকেও ক্রিকেটারদের উচ্ছ্বাসের শব্দ শোনা যায়। ভাব দেখে মনে হয় শুধুমাত্র ক্রিকেট খেলতেই তারা আমেরিকা এসেছে। তবে সৌরভ ভাই খুব ভাল ক্রিকেট খেলেন। বিভিন্ন স্টেট থেকে লোকজন ওনাকে ভাড়া করে নিয়ে যায় ক্রিকেট খেলার জন্য। শরিফ ভাইকে কেউ ভাড়া করে নিয়ে যায় না। তবে উনিও খুব ভাল ক্রিকেট খেলেন। প্রায়ই ম্যান অফ দা ম্যাচ হন। ক্রিকেটের জন্য কিনা জানি না, এত এত বদগুণ সত্ত্বেও শরীফ ভাইকে সবাই খুব পছন্দ করে। উনি যেখানেই যান, যা করেন ব্যাচেলর ছেলেগুলো তাই করার চেষ্টা করে। আমি শরীফ ভাইয়ের মত করার কিছু চেষ্টা করি না। তবে শরীফ ভাইকে আমারও খুব ভাল লাগে।
শরীফ ভাই দেখতে বেশ স্বাস্থ্যবান। মনে হল টানাটানি খুব ভাল পারবেন। ঐদিন শরীফ ভাইকে সকাল থেকে ফোন দিচ্ছি। উনি দু ঘণ্টা পর এলেন। আমি বেশ বিরক্ত। শরীফ ভাই খুব কষ্ট করলেন। আমার সব জিনিস টেনে দিলেন। আমাকে কিছুই করতে হল না। অনেক জিনিস ছিল। আমাদের তিন বার আসা যাওয়া করা লাগল। বাসায় ঢোকার সময় উনি আমাকে দরজাটাও খুলে দিলেন। এখানে দরজা খুলে দেওয়া একটা ভদ্রতা। বাংলাদেশের মত দুম করে কেউ দরজা বন্ধ করে না। কেউ আসছে দেখলে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা খুলে দিলেও মেয়েদের বাসা বলে শরীফ ভাই বসলেন না। চলে গেলেন। শরীফ ভাইয়ের ভদ্রতায় আমি ও সুরিয়া দুজনই খুব মুগ্ধ। সুরিয়া বললো, ছেলেটাতো ভাল। তুমি কাল, লম্বা ছেলে চাও। এতো সেরকমই। তাহলে বিয়ে করছ না কেন?
সুরিয়া আমাকে বললো, দেখ আমার বাসা খুব ছোট। তুমি তোমার জিনিসপত্র বের করো না। আমারগুলো ব্যবহার কর। আমি বললাম, ঠিক আছে। তবে বদনাটা আমাকে বের করতে হল। সুরিয়ার বাথরুমে কোন বদনা নেই। বদনা ব্যবহার একটি অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার তার কাছে। বাথরুমটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে সুরিয়া। লাল কার্পেট দেওয়া, ফ্লাওয়ার ভেস আছে। সেখানে হলুদ রঙের প্লাস্টিকের ফুল রাখা।
বেডরুমটা দেখলাম। একটা বেডরুম এ বাসায়। ওখানে সুরিয়া আর মথু থাকে। মথু হল সুরিয়ার বয়ফ্রেন্ড। ওরা দুজনই সাউথ ইন্ডিয়ান। দুজনেই ইন্ডিয়াতে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। এখানেও ওরা একি ডিপার্টমেন্টে পড়ে। ওদের বিয়ে হয়নি এখনও। স্বামী স্ত্রীর মত একসাথে থাকে ওরা। তবে এ বিষয়টি সুরিয়া কাউকে বলতে চায় না। আমাকেও শিখিয়ে দিয়েছে মিথ্যে বলার জন্য। যদিও ব্যাপারটি সবাই ই জানে। আর এখানে অনেক ইন্ডিয়ানই এরকম করে থাকে। সুরিয়ার সাথে আমাদের পরিচয়, সুরিয়া আমাদের আগের বাসায় এক মাস ছিল। ওদের বাসায় ছারপোকা পাওয়া গিয়েছিল। আমেরিকানরা ছারপোকা খুব ভয় পায়। ওদের ৫১০০ ডলার জরিমানা হল। আর বাসা ছেড়ে দিতে হল। তবে টাকাটা ওদের এখনি দিতে হবে না। বাড়িয়ালা কালেকশন এজেন্সিকে দায়িত্ব দিয়েছে। ওরা চাকরি পাবার পর দিতে হবে। এখানে কোন ফি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেউ না দিতে পারলে কালেকশন এজেন্সির কাছে সেটা চলে যায়। কালেকশন এজেন্সি ঐ ব্যক্তির সুবিধামত সেটা আদায় করে। তাড়াহুড়া করে বাসা না পেয়ে সুরিয়া উঠল আমাদের সাথে আর মথু উঠল সৌদি আরবের এক ছেলের সাথে।
সে সময়টা সুরিয়াকে দেখতাম রোজ সকালে উঠত, রান্না করত। তারপর মথুর জন্য সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার সঙ্গে করে নিয়ে যেত। সন্ধায় ফিরে আবার মথুর রাতের খাবার রেডি করত। মাঝে মাঝে কাপ্সা রান্না করত। কাপ্সা হল সৌদি এরাবিয়ান রাইস। মথু একটা সৌদি এরাবিয়ান ছেলের সাথে থাকত। ওর কাছেই শিখেছে রান্নাটা। টমেটো আর মুরগীর নির্যাস দিয়ে বানানো মাংস ছাড়া রাইস। নির্যাস মানে মুরগীর ঝোলটা দিয়ে রাইসটা রান্না করা হয়। আর বেঁচে যাওয়া মুরগীটা পরে ফ্রাই করে খাওয়া যায়। সুরিয়ার কাপ্সা খুব মজা হত। ও কাপ্সা রান্না করলে আমারা অপেক্ষা করতাম কখন আমাদের খেতে বলবে। সুরিয়া আমাদেরকে একটু আধটু দিত। তখন আমি, নাসরিন কয়েকবার না বলতাম। তারপর ওর কাপ্সার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম।
একবার সে একটা সাউথ ইন্ডিয়ান চিকেন রান্না করে রেখে গেছে। ভদ্রতার খাতিরে আমাদেরকে টেস্ট করতে বলেছে। টেস্ট করতে যেয়ে আমরা ভীষণ অভদ্র হয়ে উঠলাম। ওরা সারা সপ্তাহের রান্নার অর্ধেক খেয়ে ফেললাম। আর খুব কষ্টে নিজেদেরকে সংবরণ করে বাকি অর্ধেক রেখে দিলাম। সুরিয়া বাসায় আসল। আমরা দুজন আর লজ্জায় রান্না ঘরে যেতে পারছিনা। পরদিন বিকেলে ওর সাথে আমাদের দেখা হল। আমরা খুব মুখ কাঁচুমাচু করে খাওয়ার ব্যাপারটা বললাম। ও বললো, জানো আমি ফ্রিজে রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। পুরাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখনি ফেলে দিলাম, তোমরা খেয়েছ খুব ভাল করেছ। আমার আর নাসরিন এর খুব রাগ হল তখন। মনে হচ্ছিল, সুরিয়াকে তক্ষুনি মেরে ফেলি। কিভাবে এত মজার খাবার ফ্রিজে রাখতে কেউ ভুলে যেতে পারে। সুরিয়া মেয়েটা সত্যি অসাধারন রাঁধে। কাঁদেও খুব অসাধারণ। ঐদিন সে কাঁদার কারণে ভুলে গিয়েছে। মথুর সাথে ঝামেলা হলে সে পুরা একদিন কাঁদে। তারপর আমাদেরকে কান্নার কারণ বলে। প্রতিবারের কারণ একই। মথু এখনই তাকে বিয়ে করতে চায় না। আরও সময় নিতে চায়।
সুরিয়া আমাকে বললো তুমি বেড রুমে ঘুমাতে পার আমার সাথে। আমি তবু বললাম, না ডাইনিং স্পেসে আমার কোন অসুবিধা নেই। সুরিয়ার বয়ফ্রেন্ড মথু টেক্সাসে গেছে। তিন মাসের জন্য ইন্টার্নশিপ করতে। ওর একার জন্য বাসা ভাড়াটা বেশি হয়ে যায়। আবার নাসরিনও সামারের ছুটি শেষে তিন মাস পর ফেরত আসবে। তাই সুরিয়ার কাছে উঠি আমি। নাসরিন ফিরলে আবার একসাথে বাসা নেব। সুরিয়া খুব ভাল মেয়ে। নতুন জায়গা, তবুও খারাপ লাগছিল না। রাতে আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনলাম। সকালে দেখি সুরিয়ার চোখ ফোলা। অনেকদিন পর সে মথুকে ছাড়া আছে। তাই তার খারাপ লাগছে।
সকালে সুরিয়া ডিপার্টমেন্ট যাওয়ার জন্য রেডি হল। আমিও হলাম। এই বাসাটা অনেক দূরে। ক্যাম্পাস থেকে ত্রিশ মিনিটের হাঁটা পথ। আমি সারাদিনের প্রয়োজনীয় সব কিছু প্যাক করে নিলাম। সুরিয়ার একটা সাইকেল ছিল। তবে আজ সে হেঁটে যাবে। আমাকে রাস্তা ঘাট চিনিয়ে দিবে। আমরা একটু ভিতরের দিকের রাস্তা দিয়ে গেলাম। পথে একটা রেল লাইন পড়ল। তারপর সব আবাসিক এলাকা। খুব নিস্তব্ধ। কোন কোন বাসা খুব বেশি পুরনো। মনে হচ্ছিল কেউ সেখানে থাকে না। সব বাসাগুলো দেখতে প্রায় একই রকম। সামনে পিছনে লন। লনের ঘাস সুন্দর করে ছাঁটা। প্রত্যেক বাসার সামনেই কিছু চেয়ার পাতা। বারবিকিউ করার জায়গাও আছে। সন্ধ্যায় সুরিয়াকে বললাম, তুমি চলে যাও। আমি একা যেতে পারব। আমি আন্দাজ করে করে রাস্তা খুঁজে বাসায় চলে আসলাম।
আমি এখন রাস্তা ঘাট চিনি। নিজেই হেঁটে হেঁটে সাহস করে প্রতিদিন নতুন নতুন রাস্তা বের করি। তবে রাস্তা বের করাটাও তেমন কঠিন কিছু ছিল না। সমতল এলাকা হবার কারণে এখানকার রাস্তাঘাট বেশ সোজা। লম্বা লম্বি আর আড়াআড়ি। পূর্ব পশ্চিম বরাবর সব এভিনিউ আর উত্তর দক্ষিন বরাবর স্ট্রীট। এ বাসাটাও মেডারি এভিনিউ এ। তবে ফরেস্ট স্ট্রীটে। সবসময় একা একা যেতাম আর একা একা ফিরতাম। পথে একটা বাড়ি পড়ত। সেখানে একটা কুকুর খুব ঘেউ ঘেউ করত। আমি পাঁচটার পর ফিরতাম। কোনদিন কোনদিন ছ’টাও বাজত।
সামারে সুর্য ডুবত বেশ দেরিতে। কটকটা রোদ থাকত তখন। তবুও দেখতাম, আমেরিকানরা বাসায় সন্ধ্যের লাইট জালিয়ে দিয়েছে। খুব কুৎসিত লাগত সেটা দেখতে। দিনের উজ্জ্বল আলোয় সে আলো ভীষণ ম্লান দেখাত। ফ্রাইডে বিকেলে আমি আর সুরিয়া একসাথে ফিরতাম। আমরা ডিপার্টমেন্ট থেকে একবারে ওয়ালমার্ট চলে যেতাম সারা সপ্তাহের বাজার করার জন্য। মথু সঙ্গে করে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। তাই সুরিয়ারও গাড়ি ছিল না। আমরা দুজন হেঁটে হেঁটে যেতাম। পথে একটা পার্ক পড়ত। ওটাকে ম্যাকরি গার্ডেন বলে। গার্ডেনের ভেতর দিয়ে গেলে দূরত্ব অর্ধেকের থেকেও কমে যেত। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে আমরা গার্ডেনে জিরোতাম। গাছের ছায়ায় বসতাম। বিভিন্ন রঙের ফুল দেখতাম। গার্ডেনের গাছপালা বোঝার চেষ্টা করতাম।
মাঝে মাঝে উদাস হলে ব্যক্তিগত গল্প আসত। ও আমাকে জিজ্ঞেস করত আমার কেন বয়ফ্রেন্ড নেই। নিশ্চয়ই আমি কোন কঠিন আঘাতের স্বীকার। কেউ আমাকে ঠকিয়ে চলে গেছে। সেই দুঃখে নতুন কাউকে জোটাচ্ছিনা। আমি বললাম, সেরকম কিছু নয়। সুরিয়া বললো, তাহলে তাড়াতাড়ি কাউকে জুটিয়ে ফেল আর তুমি কি জান, আমেরিকাতে সিঙ্গেল থাকা খুব লজ্জার। এর মানে কেউ তোমাকে চায় না। একজন সঙ্গী পাবার মত যোগ্যতা তোমার নেই। আর একটি ধারণাও এখানে করা হয়, তুমি বিপরীত কারও সাথে মিশছ না। তাহলে নিশ্চয় লুকিয়ে তোমার মত কার সাথে (হোমো ) মিশছ। তাই এখানে ষোল বছরের পর ছেলে মেয়েরা একা একা ঘুরলে বাবা মা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে রাত কাটিয়ে আসলে তাদের চিন্তা দূর হয়। আমি বললাম, তোমার কি আমাকে সেরকম মনে হয়। সুরিয়া বললো, না এমনিতেই বললাম। জানোতো এদেশে সবই হয়। আমার সাথে একটি জার্মান মেয়ে পড়ে। কেমন করে আমার দিকে তাকায়, পরে শুনি মেয়েটি হোমো।
ও আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি ওর কথায় মন খারাপ করেছি কিনা। বলি করিনি। কিন্তু বাজার নিয়ে ফেরার সময় আমার মনে হয় সত্যি একজন পুরুষ সঙ্গী আমার দরকার। যে আমাকে বাজারে নিয়ে যাবে। সব বাজার টেনে টেনে গাড়িতে তুলবে। গাড়ি থেকে নামাবে আর জিজ্ঞেস করবে আমি ঠিক আছি কিনা। কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। অসুবিধা হলেও, আমি বলব হচ্ছেনা। আমি বাসায় এসে ভাত চাপিয়ে দেব। তার জন্য রান্না করব। তারপর একসাথে খাব। খুব খারাপ রান্নাও সে গপ গপ করে খেয়ে ফেলবে।
নাসরিন তখন দেশে। সামারে কোনও কোর্স নেই আমার। শুধু রিসার্চ। তাই হাতে বেশ খানিকটা সময় থাকত। বাসায় ফিরে সুরিয়া মথুর সাথে গল্প করে। আমি ইউটিউবে একটা নাটক খুলে বসি। সেখানেও সেই সঙ্গীর গল্প।
সঙ্গী ব্যাপারটা আমার মাথায় তখন থেকে ঢুকে গেল। এলোমেলো অনেক ভাবনা আসতে লাগল।
প্রবাসে সিরিজের গল্পসমূহঃ
☑ পর্ব ১ঃ যাত্রাপথের গল্প
☑ পর্ব ২ঃ নতুন বাসা, ওরিয়েন্টেশন, রাস্তা হারানো
☑ পর্ব ৩ঃ পুলিশ আসা, রেজিস্ট্রেশন বিড়ম্বনা
☑ পর্ব ৪ঃ ডরমেটরির গল্প, প্রথম তুষারপাত
☑ পর্ব ৫ঃ ইন্টারন্যাশনাল নাইট, বাসা নিয়ে ঝামেলা, শায়লা আপুর চলে যাওয়া
☑ পর্ব ৬ঃ কামরানকে হাসপাতালে নেওয়া, টেকো সুদীপ আর ব্রিটিশ প্রফেসরের গল্প
☑ পর্ব ৭ঃ ল্যাব ও ফরাসী যুবকের হৃদয় ভাঙার গল্প।
☑ পর্ব ৮ঃ সামার এসেছে, বেতন পাইনি, প্রথম বাসা ছেড়ে দিলাম
☑ পর্ব ৯ঃ সঙ্গীহীন জীবন, সুরিয়া মথুর গল্প, সামারের দিনলিপি, একা পথ চলা
☑ পর্ব ১০ঃ বিদেশী ভাষা শেখা ও আমেরিকান চাষাবাদের গল্প
☑ পর্ব ১১ঃ আমার বাইবেল শেখা
☑ পর্ব ১২ঃ সাজ্জাদের চলে যাওয়া, লিবিয়ান পরিবারের গল্প
☑ পর্ব ১৩ঃ মুহিত ভাইয়ের গল্প, আমার আগুন ধরিয়ে ফেলা
☑ পর্ব ১৪ঃ মসজিদ, ঈদ, ইয়ামিনী আসা, নতুন বাসা, আমেরিকান বিয়ে ও অরিগন যাবার গল্প
☑ পর্ব ১৫ঃ
☑ পর্ব ১৬ঃ
☑ পর্ব ১৭ঃ
☑ পর্ব ১৮ঃ
☑ পর্ব ১৯ঃ
লেখক পরিচিতিঃ
জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ ক্যারোলিনা এ এন্ড টি স্টেট’ ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ‘PhD’ করছেন এবং তার গবেষণার বিষয় হল ‘Real time Object detection with Higher Accuracy’। জান্নাতুন নাহার তন্দ্রার স্কুল জীবন কেটেছে চুয়াডাঙ্গা শহরে, কলেজ জীবন হলিক্রস কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। এবং সেখান থেকেই ২০১০ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষে ২০১২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং ২০১৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা অবসরে লিখতে ভালবাসেন এবং সে অভ্যাস বশতই আমেরিকার গ্রাজুয়েট প্রোগামে একা একটি মেয়ে পড়তে আসার অভিজ্ঞতা (সাউথ ডাকোটা) একসময় তিনি লিখতে শুরু করেন। এবং তার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘প্রবাসে’ নামে ২০১৫ সালের ‘একুশে বই মেলায়’ তার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি কোন তথ্যমূলক বই নয় বরং বলা যায় এটি লেখিকার রোজকার ডায়েরী।