আমি এয়ারপোর্টে বসে আছি। বোর্ডিং শুরু হলে প্লেনে ঊঠবো। আমার সাথে দুটি বাচ্চা যাচ্ছে। তাদের বয়স ১০-১২। তারা খুব ছোটাছুটি করছে। আর মাঝে মাঝেই হি হি করে হাসছে। আমাকে নিয়ে হাসছে কিনা কে জানে। আমিও একটি হাসি দিলাম। সাথে সাথে তাদের হাসি হাসি মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বোর্ডিং শুরু হলে এয়ারপোর্টের এক মহিলা এসে বাচ্চাদুটোকে বললো, লক্ষ্মী হয়ে থাকবে। পৌঁছালে মমকে ফোন দিবে, সি উইল পিক ইঊ।
প্লেনে ঊঠলাম। এই বয়সে কি কি করতাম মনে করার একটা চেষ্টা করলাম। সবখানে মায়ের সাথে যেতাম। রিক্সায় মায়ের সিল্ক শাড়ীর উপর বসতাম আর পিছলে পিছলে পড়ে যেতাম। প্লেন টেক অফ করল। আমরা উপরে উঠতে শুরু করলাম। একসময় সব কিছু বিন্দুর মতো হয়ে গেলো। সেই প্রথম দিনের মতো, যেদিন দেশ ছেড়েছিলাম। সেদিনের খুব বেশি কথা মনে নেই। মনে করলেও বেশি কিছু মনে পড়ে না আমার। আমার মা খুব ছিঁচকাঁদুনে ধরনের। প্রচন্ড কাঁদতে পারেন উনি। মায়ের কান্না ভেজা চোখ দু’টোই শুধু মনে পড়ল ।

প্লেনের এনাউন্সমেন্টে ঘুম ভাঙল। ডেনভার এসে গেছি। ডেনভার সময় অনুযায়ী এখন সাতটা বাজে। তারমানে সাউথ ডাকোটায় আটটা আর অরিগণে ছয়টা। আমেরিকার এক এক জায়গার এক এক সময়। প্রথম দিকে খুব অবাক হতাম। এক দেশ, সময় আলাদা! আমেরিকা বেশ বড় দেশ। বড় দেশ হওয়ায় এর বিভিন্ন জায়গা বিভিন্ন দ্রাঘিমাংশে পড়েছে তাছাড়া এলিভেসনের তারতম্যও আছে। তাই সময় আলাদা। সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবেও আলাদা সময়ে। আমার পিঠে একটা ব্যাকপ্যাক। কোন লাগেজ নেই। হাতে দু ঘণ্টা আছে। এই দুই ঘণ্টা আমি এয়ারপোর্ট ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ফাঁকে ফাঁকে বাথরুমে গেলাম। চুল ঠিক করলাম, লিপিস্টিক ঠিক আছে কিনা দেখলাম। পোর্টল্যান্ড বিমানবন্দরে আমাদের বিমান ল্যান্ড করল। ওয়েবে দেখেছি পোর্টল্যান্ড আমেরিকার ২৩ তম বড় শহরের একটি। রাতের আলো ঝলমল আর উঁচু বিল্ডিং দেখে সেটি নিশ্চিত হলাম। একসময় বাসস্থান হিসেবেও এটি নাকি আমেরিকার মধ্যে এক নম্বরে ছিলো।

রাশেদ ভাই আমাকে নিতে আসবেন। অরিগন পোর্টল্যান্ড বিমানবন্দরে রাশেদ ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। রাশেদ ভাইকে আগে থেকেই চিনি। তবে তার গাড়িতো চিনি না। টার্মিনালগুলোর সামনে খুব অল্পসময় গাড়িগুলো দাঁড়াতে পারছে। ভাইয়ার সাথে কথা হচ্ছে, ভাইয়াকে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিনা। ভাইয়া আমাকে শুধু বলছেন তুমি দেখতে কেমন বলত। চুল সোজা না কোঁকড়া। লম্বা না ছোট। আমি আমার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেবার চেষ্টা করছি। তবুও ভাইয়াকে খুঁজে পাচ্ছিনা। ভাইয়াকে ফোনে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। আমি অবশ্য চিন্তিত নয়। রাতের আলো ঝলমলে এয়ারপোর্ট আমার বেশ লাগছে। এত অগণিত মানুষ, এরা কেউ আমার চেনা নয়। কোন মানুষ আমি দুবার দেখছিনা। ক্রমাগত বদল হচ্ছে মানুষ। গাড়িগুলো বেশিক্ষণ দাঁড়াচ্ছেনা। ক্রমাগত বদল হচ্ছে।

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বদল হওয়া দেখছি। রাশেদ ভাই আমাকে খুঁজে পেয়েছেন। আরে তুমি নিচতালায় আর আমি গাড়ি নিয়ে দুতালায় চক্কর দিচ্ছি আর হাঁ করে মেয়ে দেখছি। কি বিচ্ছিরি অবস্থা বলোতো। যাকে দেখি তাকেই মনে হয় তুমি নাতো? আর তুমি বললে ফ্রন্টিয়ার এয়ারলাইন্স। আচ্ছা যাই হোক সিটবেল্ট বাঁধো। আমরা রাশেদ ভাইয়ের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি। রাত ১১টার মত বাজে। ডাকোটা হলে, এতক্ষণে শহর ঘুমিয়ে পড়ে। তবে এ শহর ঘুমিয়ে নেই। অরিগনকে বলা যেতে পারে অনেকটা পাহাড়ের দেশ। ডাকোটার মত এত সোজা রাস্তাঘাট এখানে নয়। আমাদেরকে অনেক র‍্যাম্প আর এক্সিট নিতে হচ্ছে। রাশেদ ভাই আমার সাথে গল্প করছেন। আমিও হাল্কা হাল্কা গল্প করছি আর মুগ্ধ হয়ে রাশেদ ভাইয়ের গাড়ি চালানো দেখছি। ও তোমাদের বাসা ফয়সালদের বাসার কাছে। আরে আমরা তো একই সাথে পাবনা ক্যাডেট কলেজে পড়তাম। রাশেদ ভাই ক্রমাগত কথা বলে চলেছেন। আমি হু হা করছি আর রাতের অরিগন দেখছি।

রাশেদ ভাইয়ের পোর্টল্যান্ডের বাসায় আমরা পৌছালাম। চমৎকার নেইবারহুড। বাসাও চমৎকার। অরিগনে এসে আমি যা দেখছি তাই ই চমৎকার মনে হচ্ছে। রাশেদ ভাইয়ের বউ রিমি আপুকেও খুব চমৎকার লাগছে। ক্যাম্পাসে এত সুন্দর কখনও লাগেনি মনে হচ্ছে। আপুকে বললাম তুমি খুব সুন্দর হয়ে গেছো।

-আরে না, আমার কত ওজন বেড়েছে জানো ২ কেজি।
আমি ফ্রেশ হয়ে রিমি আপুর সাথে গল্প করছি আর খাচ্ছি। আপু আমার জন্য অনেক রান্না বান্না করেছেন। আপুকে ক্যাম্পাসে দেখলে একটু ভয় পেতাম। এখন আর ভয় লাগছেনা। মাঝে মাঝে আমরা খুব হাসাহাসি করছি। রায়হান ভাই টিভি খুলে কিছু একটা দেখছেন। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে টিভির কোন কিছু তিনি শুনছেন না, এদিকে কান খাড়া করে রেখেছেন। কারণ আমাদের প্রতিটি গল্পে তিনিও হাসছেন আর টুকুশ করে মন্তব্য করছেন। রাশেদ ভাই আপু দুজনেই সি এস ইর। আমি তাদের ডিপার্টমেন্টের নয় তবে ক্যাম্পাসের। আমাদের গল্পগুলো সব ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক হচ্ছে। খুব ভাল লাগছে গল্প করতে। সাত বছর আগে পা রাখা সবুজ ক্যাম্পাসটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

রিমি আপুর প্রতিটি রান্না চমৎকার। আপু ইন্টেলে চাকরি করছেন, সাথে ঘর সংসারও সামলাচ্ছেন। রায়হান ভাই এক একবার বাইরে যাচ্ছেন। এক একজনকে এয়ারপোর্ট থেকে পিক করছেন। তারা হোটেলে থাকবে সেরকমই কথা। তবে ডিনারের জন্য ভাইয়া বাসায় এনেছেন। এক একজন করে ভাইয়া আসছেন। ভীষণ গল্প করছে ওরা। সব ই ক্যাম্পাসের গল্প। খুব হাসি শোনা যাচ্ছে। আমি ওদের সাথে গল্প করছি না। তবে রাশেদ ভাইয়ের মত কান খাড়া করে সব শুনছি, আপুকে রান্নায় সাহায্যের চেষ্টা করছি। আপু যদিও আমাকে কিছুই করতে দিচ্ছেন না। তবুও করছি। ফ্রিজ খুলে তরকারি নামাচ্ছি। খাবার জন্য থালা বাসন নামাচ্ছি। আমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি যেন এ পরিবারের একজন সদস্য হয়ে গেছি। আপুও মনে হচ্ছে যেন আমার পরামর্শ ছাড়া কিছুই করছেন না। আপু বললেন, আচ্ছা সকালে তো সবাই এখানেই নাস্তা করবে। এই মাফিনে হবে না? আমি জানি না হবে কিনা। তবুও নিশ্চিত ভঙ্গিতে বললাম, হবে। মাংস কসিয়ে রেখেছি বুঝেছো। নামিয়ে কি আর একটু ঝোল দেব। নাকি এতেই হবে? বললাম এতেই হবে। ডাল আর একটু পাতলা করি না? তাহলেই সবার হয়ে যাবে। বললাম হয়ে যাবে।

সবাই চলে গেলে আমি আর রিমি আপু শুয়েছি। রাশেদ ভাই ড্রয়িং রুমে। ভার্সিটির সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাচের আপুর সাথে ঘুমাচ্ছি। আমি কিছুটা চিন্তিত। ঘুমের মধ্যে আমি কখনও স্বাভাবিক থাকতে পারি না। ৪৫ ডিগ্রি এঙ্গেলে মাঝখানে চলে আসি। আমার এই ৪৫ ডিগ্রির ব্যাপারটা আপু ঠিক কিভাবে নেবে বুঝতে পারছি না। আমার আবার গায়ে পা তোলার অভ্যাসও আছে। প্রচণ্ড চিন্তা নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল আপুর ডাকে। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি প্রচণ্ড ঘেমে ভিজে গেছি। অরিগনের কোন বাসায় এসি থাকে না। বারো মাস বৃষ্টির কারণে এখানে মেঘ থাকে। মেঘের কারণে তাপমাত্রা বেশি। আদ্রতাও এখানে কিছুটা বেশি। তবে আমেরিকানরা এই গরম উপভোগ করে। শুনেছি অরিগনে কেউ রাজপ্রাসাদ বানালেও এসি লাগায় না। আমি বুঝলাম, রাশেদ ভাই আর রিমি আপুও এই গরম উপভোগ করছেন। তবে আমি করছি না। কারণ আমি এসেছি সাউথ ডাকোটা থেকে। যেখানে বছরের নয় মাস শীত থাকে। সাত মাস তুষারপাত হয়। এখানে ঘেমে ভিজে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে আমার। আপু বললেন, গরম লাগছে কিনা। বললাম না, বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া। আপু বললেন, আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি এখানকার আবহাওয়া খুব চমৎকার, ভাল লাগবেই তোমার।

আমি নাস্তা করে রাশেদ ভাইয়ার সাথে ঘুরতে বেরিয়েছি। বাসায় আরও লোক আসবে। তাই দুপুরের রান্নার জন্য আপু থেকে গেলেন। ঘুরতে বেরিয়ে অরিগনের আবহাওয়া আমার কাছে চমৎকার মনে হওয়া শুরু করল। অরিগনের রাস্তা ঘাট ফুলে ভর্তি। কিছুক্ষণ পর পর মোড়ে মোড়ে রঙ বেরঙের ফুলের গাছ। রাশেদ ভাই ক্রমাগত গল্প করছেন। গল্পের মধ্যে বললেন, আমেরিকানদের ধারণা সবসময় মেঘে ঢাকা থাকার কারণে অরিগন বাসিন্দাদের মন গ্লুমি থাকে। সেই গ্লুমি মন ভাল রাখতে এত ফুলের বাগান। রাশেদ ভাইয়ের সাথে আমার গল্পের বিষয়বস্তু রিসার্চ, ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিং আর জব ফিল্ড। খুব খট মট আলাপ। আমি কোন মজা পাচ্ছি না কিন্তু মজা পাওয়ার ভান করছি। রাশেদ ভাই বললেন, রিসার্চে কেমন অগ্রগতি? অগ্রগতি তেমন নয়। তবুও বললাম, অগ্রগতি ভাল।
তোমাদের ফান্ড দেয় কে?
– নাসা, ইউ এস জি এস …।
নাসা? নাসা টাসা এখানে কিছু না। নাসা তো এখানে একটা কোম্পানি। নিজেকে কিছু করা লাগবে বুঝেছ। প্রফেসরকে তাগাদা দাও। পেপার বের করতে হবে। পেপার ছাড়া দাম নেই।

বৃষ্টি নেমে গেছে। আমি রাশেদ ভাইয়ের বকবক শুনছি আর বৃষ্টি দেখছি। রাশেদ ভাই এমনিতে বেশি কথা বলেন না। ভাইয়া ডাবল স্ট্যান্ড করা। তার আন্ডারগ্রেডের ফলাফলও চমৎকার। সবাই তাকে কম কথা লোক বলেই চেনে। আমার ধারণা ভাইয়া এ বছরের গেট টুগেদারের আয়োজক কমিটিতে আছেন এবং অনেক বছর পর ক্যাম্পাসের এক জুনিয়র পেয়েছেন। তাই অতি আনন্দে এত কথা বলছেন। ঘোরাঘুরির মাঝে আমরা কিছু দোকানে নামলাম। আমি রামিসা আর নুশেরার জন্য দুটি খেলনা কিনলাম। ভাইয়া বিল দিতে চাইল। আমিই দিলাম। তবে ভাল লাগল, বিদেশে এই প্রথম কেউ বিল দিতে চাইল।

দুপুরে খেয়ে আমরা আবার বেরোলাম। উদ্দেশ্য রোজ গার্ডেন, জাপানিজ গার্ডেন দেখা। রিমি আপু কাকে যেন ফোন করে আমাদেরকে স্টুডেন্ট পাস পাইয়ে দিল। রোজ গার্ডেনে যাওয়ার আগে আমরা জাপানিজ গার্ডেনে গেলাম। জাপানিজ গার্ডেনের পুরো এলাকা জুড়ে বিভিন্ন রকমের ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের বনসাই। আরও রয়েছে জাপানীজ বিভিন্ন স্থাপত্য শৈলী তবে এখন ঠিক অতটা মনে নেই। তবে এটুকু বলা যেতে পারে জাপানী গার্ডেন যেন আমেরিকা–জাপানের সেতু বন্ধনের এক সাক্ষী। জাপানিজ গার্ডেনে আরও একটি পরিবারের সাথে দেখা হল। ভাইয়ারা সিয়াটল থেকে এসেছেন। ‘স্লিপলেস ইন সিয়াটল’ মুভির সিয়াটল থেকে। ভাইয়া ৮৪ এর ব্যাচ। আরও অনেকে আসছেন। কেউ ৮২, কেউ ৮৫ এর ব্যাচ। খুব ভাল লাগছিল আমার। এরা যখন ক্যাম্পাসে পা দিয়েছে, তখন আমার জন্মই হয়নি। সে অর্থে অন্য একটি জেনারেশন বলা যায়। জুনিয়ররাও এসেছে। তবে সবচেয়ে কনিষ্ঠ ব্যাচ হিসেবে আমার ঠাঁই হল।

রোজ গার্ডেনে না গেলে আমার সত্যিই বোধ হয় জানা হত না যে রোজ গার্ডেনের একটি চমৎকার ইতিহাস আছে। রোজ গার্ডেন পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে। তবে আমেরিকানরা তাদের এই রোজ গার্ডেনকে নিয়ে একটু বেশী আহ্লাদ করে এর চমৎকার ইতিহাসটির জন্য। ইতিহাসটি হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপিয়ান গোলাপ প্রেমীরা ভয় পেয়ে গেল, যুদ্ধের কারণে তাদের এত সাধের গোলাপের কোন ক্ষতি হয় কিনা, বা চিরতরে কোন প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যায় কিনা। তখন গোলাপ রক্ষার জন্য সব গোলাপ এর প্রজাতি তারা আমেরিকায় পাঠানো শুরু করল। ১৯১৭ সালে পোর্টল্যান্ডের একদল নার্সারি মালিকের মাথায় রোজ গার্ডেন প্রতিষ্ঠার আইডিয়া আসে। রোজ গার্ডেনে এখন মোট ৫৫০ প্রজাতির ৭০০০ গোলাপ গাছ আছে। সাথে ঝর্ণা, ছোট ছোট বিশ্রাম ছাউনি রোজ গার্ডেনের রূপ যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়িক ভাবে রোজ গার্ডেনের ফুল বিক্রি করা না হলেও বিভিন্ন পিকনিক বা ছোটখাটো ইভেন্টে এটি ভাড়া দেওয়া হয়। অনেকে বিয়ের জন্যও এটি ভাড়া করে। রোজ গার্ডেন চারটা অংশে বিভক্ত। রোজ গার্ডেনের একটা অংশের নাম শেক্সপিয়ার গার্ডেন। সেখানের প্রতিটি গাছের নামকরণ করা হয়েছে শেক্সপিয়ারের নাটকের চরিত্রের নাম অনুসারে। আর একটি অংশ রয়্যাল রোজারিয়ান গার্ডেন। প্রতিবছর পোর্টল্যান্ডে রোজ ফেস্টিভাল হয়। ওই ফেস্টিভালের সময় যারা পোর্টল্যান্ডের শাসন ক্ষমতায় থাকেন তাদের নাম অনুসারে গোলাপ গাছের নামকরন করা হয়। তাই রোজ গার্ডেন যেন অনেকটা ইতিহাসেরও সাক্ষী।

ঘোরাঘুরি শেষে আমরা আইস্ক্রিম খেলাম। কামাল ভাই–ভাবী খাওয়ালেন। ছেলেরা সবাই ডিস্ক গলফ খেলতে গেল। আমি আর ভাবী বসে বসে গল্প করছিলাম। ভাবী খুব অল্পতেই আমাকে আপন ভাবা শুরু করলেন। ওনার সংগ্রামের গল্প বললেন, বি সি এস ক্যাডার ছিলাম দুজন। চাকর বাকর গাড়ি কি ছিল না। সব ছেড়ে ছুড়ে পি আর নিয়ে কানাডা আসলাম। তোমার ভাইয়া রেস্টুরেন্টে কাজ করত, পড়ত। ভাই বোনকে টাকা পাঠাতো। তারপর আমরা পরে আমেরিকা মুভ করি। ভাবী তার সংগ্রামের কথা বলতে লাগলেন। ভাই বোনকে বড় করার কথা বললেন। ভাই বোনকে মানুষ করতে যেয়ে দেরীতে বাচ্চা নিয়েছেন সে গল্প বললেন। আমাকে বললেন, দেরি কর না। তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলো আর বিয়ে করেই বাচ্চা নিয়ে ফেলো। আমাদের মত ভুল করে আফসোস কর না। ছেলেটাকে দেখো না, বুড়ো বয়সে যতটা টেক কেয়ার করার কথা করতে পারছি না।

আমার ধারণা শিলা ভাবী তার বাচ্চাটিকে ভালই টেক কেয়ার করছেন। তার আফসোসের কারণও দেখি না। বাচ্চাটি ক্লাস সিক্সে পড়ে। সে আমেরিকার বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে, ম্যাডেল পেয়েছে। সে ভাল গানও গায়। লোক সংগীত থেকে শুরু করে ইন্ডিয়ান ক্লাসিক সব সে জানে। ভাবীর ছেলে সরফরাজ, ভাইয়াদের সাথে কিছুক্ষণ ডিস্ক গলফ খেলছিল। চমৎকার খেলছিল সে। খেলা শেষে ছেলেরা আসল। কামাল ভাই ফটো প্রদর্শনী করলেন। সব লাউ কুমড়া, জিঙ্গা, চিচিঙ্গা, লাল শাক, পুই শাকের ছবি। অসংখ্য ছবি। বিভিন্ন বছরের ছবি। কয়টি লাউ, কয়টি কুমড়া ফলেছে তাদের ডায়ামিটার, ওয়েট কত ছিল সব বলতে লাগলেন। কামাল ভাই আই বি এম এ চাকরি করেন। মনে হল চাকরিতে যেন তার মনে নেই। পুরদস্তুর কৃষক হলেই যেন তিনি সুখি। শাক–সবজির সাথে ফলের চাষ করছেন। ফুলের চাষ করছেন। ফিশিং করছেন। কামাল ভাইকে দেখে মনে হল আমেরিকাটাকে দেশ বানিয়ে ছাড়বেন উনি। এসব তো উনিই দেশেই করতে পারতেন। সেখানে ওনার কৃষক হবার স্বপ্ন আরো ভাল ভাবে পূরণ করতে পারতেন। এখানে আমি সব বাঙালিদের মধ্যে দেশ নিয়ে ভয়াবহ হাহাকার দেখি। তবুও কেউই পাকাপাকি ভাবে দেশে যেতে চান না। হাহাকার করতেই পছন্দ করেন। কি আছে এই দেশে। কিসের মোহে পৃথিবীসুদ্ধ লোক ছুটছে এখানে, এর উত্তর আমার জানা নেই।

রাতে ডিনার করলাম আর এক বাসায়। রিমি আপুর কলিগের ছেলের জন্মদিনের পার্টি। খুব আলো ঝলমলে পার্টি। এখানকার কাউকেই আমি চিনি না। সবাই বেশ সিনিয়র গোত্রের। আমি ভাষা আপুর সাথে টুক টাক গল্প করছিলাম। ভাষা আপু আবার কান্তা আপুর ফ্রেন্ড। গল্পে গল্পে বুঝলাম। এরা সবাই ইন্টেল প্রকৌশলী। ইন্টেলের মেইন অফিস অরিগনে। তাই এখানকার অধিকাংশ বাঙালিই সেখানে চাকরি করে। জীবনের একটা সময় কিছুটা কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেলেও এরা সবাই এখন বেশ পরিতৃপ্ত। অর্থবিত্তের আঁচ তাদের কথায় ও আচার আচরণে বোঝা যাচ্ছিল। আমেরিকার সব জায়গার পার্টির নিয়মগুলো দেখি একই রকম। ছেলে মেয়েরা আলাদা বসে। এখানে এসে অনেকে খুব ধর্ম কর্ম করে। উদ্দেশ্য বাচ্চা কাচ্চা যেন আমেরিকান সংস্কৃতিতে গা না ভাসায়। ধর্মের কর্মের মাধ্যমে বোঝানো, আমরা ওদের মত নই, ওদের থেকে আলাদা। তারা কতটুকু সফল হয় জানি না। তবে বাচ্চাগুলোকে দেখলাম বাংলা বলতে পারে না। বোঝে হয়ত ।

পার্টি শেষে আমরা বাসায় ফিরলাম। আপু বললো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। কাল থেকে তো মেইন প্রোগ্রাম। আমি সকালের নাস্তা গুছিয়ে রাখি। সকালে আর এক পরিবার এসে যোগ হল। ইমরান ভাই। উনি ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজের। এরা ক্যাডেট ক্যাডেট খুব গল্প করছিল। আমার ভাই ক্যাডেটে পড়ে জেনে আমাকেও গল্পে নিয়ে নিল, যেন আমার ভাই না আমিই ক্যাডেটে পড়ি। ইমরান ভাইয়ের সাথে ওনার স্ত্রী আর ছোট বোনটিও এসেছে। ছোট বোনটি এবার ইউনিভার্সিটি অফ ডেনভারে ভর্তি হয়েছে। মেয়েটি দেখতে অনেকটা বার্বি ডলের মত। মনে হয় কোলে নিয়ে বসে থাকি। ভাবী অবশ্য কোলে নিয়ে বসার মত না। বেশ স্বাস্থ্যবতী । একটা স্বাস্থ্যবতী মেয়ে যে এত আকর্ষণীয় হতে পারে ভাবীকে না দেখলে জানা হত না। ভাবীর আকর্ষণের মূল কারণ তার হাসি। ভাবী সারাক্ষন গল্প করেন। প্রতিটি গল্প রং চং দিয়ে বলেন। তারপর উনি নিজেই হেসে খুন। গল্পটি হাসির না হলেও ওনার হাসি দেখে একসময় আমাদেরও হাসি এসে যায়।

এই ভাবী পরবর্তীতে আমাকে একদিন ফোন দিয়েছিলেন। এই শোন তোমার তো বিয়ে ঠিক করেছি। ডি ইউ, সি এস ই। তারপর দেশের বাইরে পড়েছে বুঝলে। ছেলের ভাই বোনরা সব পেনিসেলভেনিয়াতে থাকে। কিন্তু ছেলের আবার খুব দেশ প্রেম। তোমার ভাইয়ার ক্যাডেটের ফ্রেন্ড বুঝলে। তোমার ছবি দেখে খুব পছন্দ করছে। গেট টুগেদারের ছবিতে তোমাকে দেখেছে। বলেছে এই মেয়েই আমার চাই। এরকম মেয়েই আমি এতদিন করে খুঁজছি। ছেলে ভীষণ ভাল। আগেই বলেছি, খুব দেশপ্রেমী ছেলে। ছেলে দেশে থাকে। ছেলের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি আছে। তবে তাই বলে তুমি কিন্তু আবার ‘অনন্ত জলিল’ ভেবনা। ছেলের উচ্চারণ ভাল। বলেই ভাবীর অট্টহাসি। ভাবীও হাসে, আমিও হাসি।

নাস্তা সেরে আমরা রওনা দিয়েছি। আমাদের গন্তব্য প্রশান্ত মহাসাগর, ক্যানন বিচ। তবে তার আগে আমরা যাচ্ছি ইকোলা স্টেট পার্কে। ওখানেই আমাদের মেইন প্রোগ্রাম শুরু হবে। অসংখ্য পাহাড়ি রাস্তা। মাইলের পর মাইল শুধু বন। বসতির দেখা নেই। শুনেছি অরিগন যুক্তরাষ্ট্রের নবম বৃহত্তম অঙ্গরাজ্য, আয়তনে বাংলাদেশের চাইতে বড় তবে লোক সংখ্যা মাত্র চল্লিশ লক্ষ। সাউথ ডাকোটার লোক সংখ্যাও বেশি নয়। আমেরিকার সংখ্যালঘিষ্ঠ রাজ্য হিসেবে এটি পঞ্চম। তবে ব্ল্যাক হিলস ছাড়া এরকম ঘন বন ওখানে নেই। অধিকাংশই চারণ ভূমি। বড় বড় শহর ছাড়া আমেরিকার অধিকাংশ জায়গা দেখা যায় এরকম ফাঁকা। জায়গার তুলনায় লোক সংখ্যা অনেক কম। বনের মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটছে। আমাদের গাড়িতে আমি রিমি আপু আর রাশেদ ভাই। রিমি আপু রাশেদ ভাই সবসময় আমাকে কাছে কাছে চোখে চোখে রাখছেন। একটু পর পর অসুবিধা হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করছেন।
অসুবিধা হচ্ছে না বলে প্রশান্ত মহাসাগরের কাছে এসে আমি হড়বড় করে বমি করে দিলাম।

 


প্রবাসে সিরিজের গল্পসমূহঃ

 পর্ব ১ঃ যাত্রাপথের গল্প
 পর্ব ২ঃ নতুন বাসা, ওরিয়েন্টেশন, রাস্তা হারানো
 পর্ব ৩ঃ পুলিশ আসা, রেজিস্ট্রেশন বিড়ম্বনা
 পর্ব ৪ঃ ডরমেটরির গল্প, প্রথম তুষারপাত
 পর্ব ৫ঃ ইন্টারন্যাশনাল নাইট, বাসা নিয়ে ঝামেলা, শায়লা আপুর চলে যাওয়া
 পর্ব ৬ঃ কামরানকে হাসপাতালে নেওয়া, টেকো সুদীপ আর ব্রিটিশ প্রফেসরের গল্প
 পর্ব ৭ঃ ল্যাব ও ফরাসী যুবকের হৃদয় ভাঙার গল্প।
 পর্ব ৮ঃ সামার এসেছে, বেতন পাইনি, প্রথম বাসা ছেড়ে দিলাম
 পর্ব ৯ঃ সঙ্গীহীন জীবন, সুরিয়া মথুর গল্প, সামারের দিনলিপি, একা পথ চলা
 পর্ব ১০ঃ বিদেশী ভাষা শেখা ও আমেরিকান চাষাবাদের গল্প
 পর্ব ১১ঃ আমার বাইবেল শেখা
 পর্ব ১২ঃ সাজ্জাদের চলে যাওয়া, লিবিয়ান পরিবারের গল্প
 পর্ব ১৩ঃ মুহিত ভাইয়ের গল্প, আমার আগুন ধরিয়ে ফেলা
 পর্ব ১৪ঃ মসজিদ, ঈদ, ইয়ামিনী আসা, নতুন বাসা, আমেরিকান বিয়ে ও অরিগন যাবার গল্প
 পর্ব ১৫ঃ অরিগন ভ্রমন, শুরুর গল্প।
 পর্ব ১৬ঃ
 পর্ব ১৭ঃ
 পর্ব ১৮ঃ
 পর্ব ১৯ঃ

লেখক পরিচিতিঃ

 জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নর্থ ক্যারোলিনা এ এন্ড টি স্টেট’ ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ‘PhD’ করছেন এবং তার গবেষণার বিষয় হল ‘Real time Object detection with Higher Accuracy’। jannatunজান্নাতুন নাহার তন্দ্রার স্কুল জীবন কেটেছে চুয়াডাঙ্গা শহরে, কলেজ জীবন হলিক্রস কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগে। এবং সেখান থেকেই ২০১০ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এরপর একটি সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষে ২০১২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং ২০১৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা অবসরে লিখতে ভালবাসেন এবং সে অভ্যাস বশতই আমেরিকার গ্রাজুয়েট প্রোগামে একা একটি মেয়ে পড়তে আসার অভিজ্ঞতা (সাউথ ডাকোটা) একসময় তিনি লিখতে শুরু করেন। এবং তার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘প্রবাসে’ নামে ২০১৫ সালের ‘একুশে বই মেলায়’ তার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি কোন তথ্যমূলক বই নয় বরং বলা যায় এটি লেখিকার রোজকার ডায়েরী।