বাঙালি হিসেবেই হয়তো দু’নম্বরি পদ্ধতি অবলম্বন করা আমাদের মজ্জাগত। অনেক গ্রুপে দেখেছি একজন আরেকজনকে উপদেশ দিয়েছেন ভিসা ইন্টারভিউতে মিথ্যে বলতে হলে “কনফিডেন্টলি”বলতে। কেউ কেউ ডিএস-১৬০ ফর্মে তথ্য গোপন করতে বলেছেন, বিশেষ করে বিদেশে আত্মীয়স্বজন থাকলে ব্যাপারটা চেপে যেতে বলার ব্যাপারটি। সত্যি বলতে, বাইরে যাওয়ার কোন কেইসেই মিথ্যে কোন তথ্য দেয়া নিজের তো বটেই, অন্য অ্যাপ্লিকেন্টদের কেইসকেও খানিকটা বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। কাজেই মন না চাইলেও সত্য তথ্য দিন, কিছু গোপন করবেন না। শেষ পর্যন্ত সত্যিটা বের হবেই। বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষের আত্মীয় ইউএসএতে থাকে, এতে অপরাধের কিছু নেই কারণ তাঁরা বৈধভাবেই থাকেন, সিটিজেন হলে ট্যাক্স দেন। এবং এর কারণে ভিসা রিজেক্ট হবার কোন কারণও নেই। ব্যাপার হল আপনার ফিরে আসার ব্যাপার, দেশে ফ্যামিলি টাই, প্রোপার্টি এসব তাঁরা বিশ্বাস করবেন কিনা।
আরও একটা ব্যাপার, আমাদের সার্টিফিকেটের নাম একেক জায়গায় একেক রকম থাকে। পিতামাতাদের আমলের নামধামের সমস্যা তো সীমাহীন। অনেকের পিতার নাম ন্যাশনাল আইডি কার্ডে একটা, পাসপোর্টে আরেকটা। এগুলো কখনো দুর্ভাগ্যক্রমে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের গাফিলতি আর আলসেমির ফসল। যেকোনো তথ্য নানান জায়গায় দিতে হয়। সব জায়গায় যেন একই তথ্য দেয়া হয়, এটা মাথায় রেখে অ্যাপ্লিকেশন করতে নামুন। আপনারই ঝামেলা কম হবে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, পরীক্ষাজাতীয় ব্যাপারে চিটিং করা বা করার চেষ্টা আমাদের জন্যই লজ্জার। আমি কারোটা দেখে পরীক্ষা দেবো, বা কারোটা কপি করবো – এ ব্যাপারগুলো বাইরের দেশে একজন স্টুডেন্ট নিজের জন্যই খুব অসম্মানজনক বলে মনে করে। তেমনি অসদুপায় অবলম্বন করাও নিজের জন্য অসম্মানজনক মনে করা উচিৎ। সত্য তথ্য দিয়ে রিজেক্ট হওয়া, মিথ্যে তথ্য দিয়ে অ্যাপ্রুভ হওয়ার চেয়ে ভালো, কারণ প্রথম ক্ষেত্রে আপনার কোন বিপদ নেই, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আছে।
ভিসা রিজেক্ট হলে অনেক সময় কারণটা বোঝা যায়, অনেক সময় যায় না। এক্ষেত্রে তদবির জাতীয় ব্যাপারগুলো মাথায় আসতে পারে, তবে এগুলোর দিকে না যাওয়াই ভালো। এতেও নিজে সহ অন্যরাও বিপদের দিকে চলে যাবেন। একটা সাধারণ ইম্প্রেশন যদি এই দাঁড়িয়ে যায় যে আমরা ভুল, মিথ্যে, অসম্পূর্ণ, দায়সারা ইত্যাদি তথ্য দিয়ে বিদেশ যেতে চাই, এটির লং টার্ম ইম্প্যাক্ট ভালো হবার কথা নয়। রিজেক্ট হলে একটু সময় নিন, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন, ভুল-টুল থাকলে ঠিক করে নিন। আবার অ্যাপ্লাই করুন, নিয়ম মেনে। ভয়ের কিছু নেই, সব রুটিন কাজ।
বাঙালি মানুষজন অ্যানালাইসিস করে বেশী, এবং অমুকভিসা অফিসার নরম, তমুক একটু শক্ত, খালি আটকে দেয় – এ জাতীয় কিংবদন্তী চালু করে।এগুলোর কোন যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি নেই। তাঁরা সবসময়ই চান একজন যোগ্য ছাত্র/ছাত্রী ভিসাপান, কাউকে আটকানোর মানসিকতা নিয়ে তাঁরা দাঁড়ান না। কাজেই কোন কাউন্টারেদাঁড়াচ্ছেন তার ওপর কিছু নির্ভর করে না। অ্যাম্বেসির ভেতরেও আশেপাশের মানুষজনেরমুখে নানান জল্পনাকল্পনা শুনবেন, এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেবেনকারণ এগুলো অপ্রয়োজনীয়। তাঁরা ইনফরমেশন ভেরিফাই করেন, দেখেন সব ঠিক আছে কিনা। সম্ভবত সবচেয়ে জোর দিয়ে চেক করেন টাকাপয়সা ঠিক আছে কিনা এটা। কারণ, কেউ যদি রিলায়েবল ফান্ড ছাড়া বিদেশ ঢুকে যায় এবং অবৈধভাবে বাস করার চেষ্টা করে (অনেকেই এটা করেছে এবং করার চেষ্টা করে, অনেক বাঙালীও) তাহলে সরকারের ওপর এটির দায় বর্তায়। ইউএস সরকার কখনোই এই ঝুঁকি নেবে না, কাজেই এমন যাতে না ঘটে সেজন্য সন্দেহ হলেই ফিরিয়ে দেয়।
আপনার প্রোস্পেক্টিভ ভার্সিটি যদি একটু পরিচিত হয়, আপনার ফান্ডিং যদি ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে পারেন, এবং যদি প্রসেসের কোথাও কোন ভুল বা মিথ্যে তথ্য দিয়ে না থাকেন, তাহলে ভয় পাবার কিছু নেই। (আমেরিকাতেও এমন অনেক ভার্সিটি আছে, যেগুলো কেউ চেনে না। এমন ভার্সিটিকে সন্দেহের চোখে দেখা হতে পারে, এটি মেনে নিতেই হবে।)
অবশ্যই কাগজপত্র নিজে থেকে দেখাতে চাইবেন না। প্রয়োজন মনে করলে ভিসা অফিসার স্পষ্টভাবে কাগজটি চাইবেন। আর কোন প্রশ্ন করলে চেষ্টা করুন যত সংক্ষেপে সম্ভব সদুত্তর দিতে, অর্থাৎ সঠিক এবং সত্যি উত্তর।
ভিসা অফিসারদের সবাইকেই একইভাবে ট্রিট করার ইন্সট্রাকশন নিশ্চয়ই থাকে। তারপরও কেউ নরম, কেউ একটু রুড মনে হয়। এটা পারসোনাল ট্রেইটের কারণে, কারো সাথে শত্রুতার কারণে নয়। যেহেতু কাউন্টারের ওপাশে যে আছে তার ব্যাপারে কিছু করা সম্ভব নয়, আমাদের নিজেদের প্রোফাইল শক্ত করা এবং নিজেদের কেইস ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রস্তুত হওয়াই যুক্তিসঙ্গত। হাসিমুখে রিজেকশন এবং ধমক দিয়েও অ্যাপ্রুভ করার কেইস কিন্তু আছে! কাজেই এটি নিয়ে ভাবার তেমন দরকার নেই।
এই কাগজটির একপাশে এক সেমিস্টারের ব্যয় লেখা থাকে, আরেক পাশে আয়। চেষ্টা করুন অঙ্কটি যেন কম হয়, এবং দু’পাশে সমান হয়। ব্যয় ২০ হাজার ডলার, আপনি সেইফ সাইডে থাকতে দেখালেন ফ্যামিলি ফান্ড এক লাখ ডলার, তাহলে বিশাল একটা অংক ডকুমেন্টে চলে আসলো। এবং যত বড় অংক, সন্দেহটাও তত বড়। গ্র্যাড স্কুলকে মেইল করলে তারা বলেই দেয় কত টাকার ব্যালান্স দেখালে আই-২০ দেবে। তার চেয়ে একটু বেশী দেখালেই যথেষ্ট। বড় অঙ্কের সাথে প্রশ্ন চলে আসবে ফ্যামিলির ইনকাম, ইনকামের সোর্স ইত্যাদি ব্যাপার – স্বভাবতই যেটি আপনি অল্প কথায় ব্যাখ্যা করতে পারবেন না, এবং না পারলে নেতিবাচক ফল আসাটাই স্বাভাবিক।
স্পন্সর হিসেবে বাবা কিংবা মা’কে দেখানোই ভালো, কারণ তাঁরা টাকা দেবেন এটা বিশ্বাস করা সহজ। দূর সম্পর্কের আত্মীয় কেন আমাকে টাকা দেবেন সেটি বিশ্বাস করানো কঠিন। দেখালেই যে আবার বিশ্বাস করবে তাও বলা যায় না। এক্ষেত্রে শুধু নিশ্চিত করুন কাগজপত্র ঠিক আছে, সন্দেহজনক কোন বড় লেনদেন হচ্ছে না ইত্যাদি। বাইরের দেশে থাকেন এমন কাউকেও স্পন্সর দেখিয়ে অ্যাপ্রুভ হবার কেইস আছে।
আই-২০ তে প্রায় পুরো টাকাটাই যদি ভার্সিটি দেয় (সেলফ ফান্ড জিরো, ফ্যামিলি অর স্পন্সর ফান্ড জিরো) তাহলে ফুল ফান্ড ধরে। এগুলো রিজেক্ট হবার সম্ভাবনা কম। দু’চার হাজার ডলার নিজের বা স্পন্সর থেকে দেখাতে হলে সেটিও মোটামুটি ফুল ফান্ডই ধরে। তবে পাঁচ হাজারের ওপর যদি স্পন্সর করতে হয়, বা অর্ধেক বা তারও বেশী যদি স্পন্সর থেকে দেখানো হয়, তাহলে সেটি পার্শিয়াল ফান্ডিং। এক্ষেত্রে টাকাপয়সা রিলায়েবল হলে, প্রোগ্রাম এবং ভার্সিটি রিলায়েবল হলে, সেখানে আগেও অনেক স্টুডেন্ট যাবার রেকর্ড থাকলে ভয়ের কিছু নেই।
সব মিলিয়ে, প্রসেসগুলো সবই রুটিন কাজ, ভয়ের কিছু নেই যদি আপনার নিজের দিক থেকে কোন সমস্যা না থাকে।
তবে সব কেইস তো আর জেনারেল কেইস হয় না। নানা কারণে অনেকের ভুল হয়, দু’বার কিছু করতে হয়, কিছু শোধরাতে হয়। সেক্ষেত্রে এগুবার উপায় আছে। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এগোন। এখন তথ্য নেই, এই সমস্যায় পড়বেন না। বরং নানান তথ্য বেশী করে আসবে, এটি সমস্যার কারণ হতে পারে! এখন যেকোনো কিছু একটা বাটন চাপলেই খুব সহজে জানা যায়।
একটি পরামর্শ থাকবে, জেনারেল যেকোনো তথ্য নিয়ে প্রশ্ন করার আগে Higher Study Abroad, GRE Center, NexTop USA, ইউএস অ্যাম্বেসির ওয়েবসাইট, ইউএস অ্যাম্বেসি ঢাকা-র ওয়েবসাইট ইত্যাদির সমৃদ্ধ ডক এবং লিংকগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখুন। নিজে পড়ে যা জানবেন, তা একটা কমেন্টে কেউ আপনাকে বোঝাতে পারবে না। স্পেসিফিক সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা হলেই তা বেশী ফলপ্রসূ। সবকিছু রেডি থাকবে – তার চেয়ে আপনার কাস্টোমাইজড কেইসটা আপনি নিজেই সলভ করতে পারলে তবেই সাফল্য। আণ্ডারগ্র্যাডের একটা স্টুডেন্টের কাছ থেকে যে পরিমাণ ম্যাচিউরিটি আশা করা যায়, তেমনটাই দক্ষ আর আপডেটেড করে তুলুন নিজেকে।
সবার সৎ উদ্দেশ্য সফল হোক। সবাইকে শুভকামনা এবং ধন্যবাদ।
– ইসহাক খান, প্রাক্তন গ্রেক ফ্যাকাল্টি
নিচের লিংক থেকে ইসহাক খানের লেখা অন্যান্য আর্টিকেলগুলো পড়তে পারেন-
☑ স্টুডেন্টদের সাধারণ দুর্বলতা – পার্ট ১ – Vocabulary
☑ স্টুডেন্টদের সাধারণ দুর্বলতা – পার্ট ২ – Analytical Writing
☑ স্টুডেন্টদের সাধারণ দুর্বলতা – পার্ট ৩ – Reading Comprehension
☑ স্টুডেন্টদের সাধারণ দুর্বলতা – পার্ট ৪ – Speaking (TOEFL)
☑ Originality of writing: এসওপি, এলওআর, ইমেইলিং প্রফেসরস, সিভি ও রেজুমে (১ম খণ্ড)
☑ Originality of writing: এসওপি, এলওআর, ইমেইলিং প্রফেসরস, সিভি ও রেজুমে (২য় খণ্ড)
☑ Customized Routine: নিয়মিত ফলো করা (১ম খণ্ড)
☑ Customized Routine: নিয়মিত ফলো করা (২য় খণ্ড)
☑ আমার জন্য সঠিক রাস্তা কোনটা: বিদেশ, জিআরই, স্বদেশ, বিসিএস, চাকরি?
☑ রেকমেন্ডেশন বিড়ম্বনা!
☑ Research: রিসার্চ বা গবেষণা
☑ ইউএস অ্যাম্বেসির ভেতরের পরিবেশ এবং স্টেপগুলো
☑ ইংরেজিতে দক্ষতা এবং কিছু স্ট্র্যাটিজি
☑ Teaching: শেখা ও শেখানো, দেয়া ও নেয়া
☑ ইউএস ভিসা পাওয়া না পাওয়া এবং হায়ার স্টাডির কিছু পয়েন্ট
☑ জিআরই এবং টোফেল: হায়ারস্টাডির প্রস্তুতি হোক স্ট্র্যাটিজিক্যালি (পার্ট- ১)
☑ জিআরই এবং টোফেল: হায়ারস্টাডির প্রস্তুতি হোক স্ট্র্যাটিজিক্যালি (পার্ট- ২)
☑ জিআরই এবং টোফেল: হায়ারস্টাডির প্রস্তুতি হোক স্ট্র্যাটিজিক্যালি (পার্ট- ৩)
☑ জিআরই এবং টোফেল: হায়ারস্টাডির প্রস্তুতি হোক স্ট্র্যাটিজিক্যালি (পার্ট- ৪)
☑ আমার অভিজ্ঞতা: জিআরই প্রস্তুতি এবং পরীক্ষা
☑ আমার অভিজ্ঞতা: টোফেল প্রস্তুতি এবং পরীক্ষা
☑ আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা এবং দরকারি কৌশল